কেউ বলে জাদুঘর, কেউ বলে উপাসনালয়, কারও বা আবার দৃঢ়বিশ্বাস, এই বাড়িতে নাকি ভূতের বসবাস! রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে নীরবে-নিভৃতে এমনি এক বিচিত্র বাড়ির নির্মাণকাজ করে চলেছেন হোসেন শহীদ সোলায়মান। নিজের বাড়ি সম্পর্কে আশপাশের লোকজনের মন্তব্য শুনে তিনি কেবল হাসেন। ‘একজন শিল্পী যখন আঁকেন, আঁকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কি বোঝা যায় তিনি কী আঁকছেন?’ লোকজনের কৌতূহলের জবাবটা এভাবেই দেন তিনি।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় শহীদ সোলায়মানের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন চিত্রকর্ম আর নান্দনিক স্থাপনার প্রতি তাঁর ভীষণ আগ্রহ। পরবর্তী সময়ে স্ত্রীর আমেরিকান দূতাবাসে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখার সুযোগও তাঁর হয়েছে। হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ডিজাইনিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
এ ছাড়া বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এই স্থাপত্যশিল্পী নিজ প্রতিষ্ঠান ‘মডার্ন বিল্ডিং কনসালট্যান্ট ফার্ম’ থেকেও শিখেছেন অনেক কিছু। ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল, আমার একটা প্রাসাদ হবে! আমার ইচ্ছা ছিল, আমার প্রাসাদে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ডিজাইন থাকবে, যার প্রতিটি আলাদা আলাদা অর্থ বহন করবে।’ এমনই পরিকল্পনা নিয়ে আজ থেকে ১৪ বছর আগে বাড়িটির নির্মাণকাজ শুরু করেন তিনি।
বাড়ির সম্মুখভাগে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখে পড়ে ময়ূর, সিংহ, চোখ, পদ্মফুল, টিয়াপাখি, মাছ, আনারস, হাত ইত্যাদির আদলে তৈরি অসংখ্য নকশা। শহীদ সোলায়মানের ভাষায়, ‘এর প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নকশা নিয়েও আছে একেকটি ইতিহাস।’ তারই মধ্যে অল্প কিছুর বর্ণনা দেন তিনি।
বাড়ির একটি স্তম্ভের নিচের দিকে চোখে পড়ে ছোট ছোট অনেক মাছের প্রতিকৃতি। দেখলে মনে হয়, মাছগুলো তাদের লেজ দিয়ে স্তম্ভটি ধরে রেখেছে। সোলায়মানের ভাষায়, মাছগুলো এই বাড়ি নির্মাণে যেসব দিনমজুর কাজ করেছেন, তাঁদেরই প্রতিচ্ছবি। যাঁদের শ্রমের বিনিময়ে বাড়িটি ১৭টি স্তম্ভের ওপর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রাজবাড়ির নিশানা হিসেবে আছে বনের রাজা সিংহ আর দুটি রাজমুকুটের প্রতিকৃতি। নিচের অংশে বড় করে তৈরি চোখটি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘মানুষ যে শুধু আমার বাড়িটা দেখবে, তা নয়, বাড়িও তার চোখ দিয়ে মানুষকে দেখবে!’ এ ছাড়া দোতলার বারান্দায় চোখে পড়ে দুটি পরি, যার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন ফলমূলের অনুকরণে তৈরি। নাশপাতি, আঙুর, আম—সবকিছুরই দেখা মিলবে সেখানে।
শহীদ সোলায়মানের ভাষায়, ‘আমার বাড়িটা হলো একটা উপন্যাসের পাতা। আর এই কলমগুলো হলো সেই কলম, যে কলম দিয়ে আমি এই উপন্যাস লিখেছি।’ স্তম্ভ দুটি সম্পর্কে এই হলো তাঁর ব্যাখ্যা। মজার ব্যাপার হলো, প্রথাগতভাবে বাড়ি নির্মাণের আগে সম্পূর্ণ বাড়ির কোনো নকশা শহীদ সোলায়মান তৈরি করেননি।
শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন করেন। কখনো হয়তো দোতলায় কাজ করছেন, পরদিনই আবার দল বেঁধে ছুটছেন তৃতীয় তলার কাজে। দিন শেষে হঠাৎই হয়তো মনে হলো, নিচতলার প্রবেশপথে আরও একটু কারুকাজ প্রয়োজন। পরদিনই দলবল নিয়ে ছোটেন নিচতলায়! বহু কষ্টে তিলতিল করে জমানো টাকায় শহীদ সোলায়মান শুরু করেছিলেন বাড়ির নির্মাণকাজ। এরই মধ্যে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। তবু লোকজনের কটাক্ষ, উপহাসকে উপেক্ষা করে তিনি নির্মাণ করে চলেছেন তাঁর স্বপ্নের প্রাসাদ!