চার দিকে ২৬টি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার চোখ। কিন্তু সব ক্যামেরাই অচল করে দেওয়া হয় হত্যাকাণ্ডের সোয়া এক ঘণ্টা আগে। তারপর খুব কাছ থেকে ঠিকাদার নাসির কাজীকে গুলি করে নিরাপদে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
গত রোববার সকালে রাজধানীর মহাখালীর দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের পাশে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নাসির কাজীর (৪৫) লাশ পড়ে ছিল। ঘটনাস্থলের আশপাশের বিভিন্ন গলিতে ২৬টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা আছে। মসজিদের ‘গ্রাউন্ডফ্লোর’ থেকে এসব সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এসব ক্যামেরার কেবল কাটা ছিল।
রোববার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ নাসিরের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। ঘটনাস্থল থেকে চারটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। ওই দিন দুপুরে মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। নাসিরের শরীর থেকে দুটি গুলি বের করা হয়। কিন্তু তাঁর বুকে ও পেটে ছিল নয়টি গুলির চিহ্ন।
ঘটনার তিনদিনেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম ফরমান আলী জানান, হত্যার আগে ফোনে দেওয়া হুমকি ও ঘটনাস্থলের সিসি টিভি ক্যামেরার কেবল কাটা থাকায় এটিকে পুরোপুরি পরিকল্পিত হত্যা ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
নিহত নাসিরের মেয়ে নার্গিস আক্তার নিপু বাদী হয়ে বনানী থানায় মামলা করেছেন। পূর্ব শত্রুতার জের উল্লেখ করে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে এই মামলায়।
সরেজমিনে জানা যায়, দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের দক্ষিণপাশের ছোট গলিপথ ধরে একটু এগোলেই হাতের বাঁ পাশে ওই মসজিদের শৌচাগার ও ডানপাশে অজুখানা। শৌচাগার ও অজুখানার মাঝেই নাসিরের লাশ পড়ে ছিল। পুলিশের ধারণা, শৌচাগার থেকে বের হওয়ার পরই নাসিরকে গুলি করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, গুলিবিদ্ধ নাসিরের মাথা ছিল পশ্চিম দিকে আর পা ছিল পূর্বদিকে। প্যান্টের বেল্ট ছিল খোলা। পড়ে থাকা লাশের এ বর্ণনা শুনে পুলিশের ধারণা, শৌচাগার থেকে বের হওয়ার মুখে নাসিরকে গুলি করা হয়, যে কারণে তিনি বেল্ট লাগানোর সময় পাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, গুলি করার পর তিনি দুই ব্যক্তিকে মসজিদের পশ্চিম পাশের গলি দিয়ে মহাখালী বাস টার্মিনালের দিকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন।
নিহত নাসিরের মেয়ে নিপু জানান, সুমন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ও এলাকাবাসীর সহায়তায় ঘটনাস্থলের আশপাশের বিভিন্ন গলিতে ২৬টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। তা মসজিদের ‘গ্রাউন্ডফ্লোর’ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
সুমন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সুমন বলেন, সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটের পর থেকে সিসি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঘটনাস্থলের পাশে নির্মাণাধীন ভবনের এক নিরাপত্তারক্ষী জানান, ঘটনার দিন সকালে তিনি ভবনের দ্বিতীয় তলার প্রাচীর পানি দিয়ে ভেজাচ্ছিলেন। এ সময় গুলির চারটি শব্দ শুনতে পান। প্রথমে ভেবেছিলেন, মিস্ত্রিরা কাজ করতে গিয়ে শব্দ করছে। এর পরই হৈচৈ শুনে নিচে এসে নাসিরকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন।
মসজিদ কমিটির সভাপতি আমান উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের এ মসজিদের কাজ নাসিরই করে আসছেন। ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে নতুন করে আবার কাজ শুরু হয়। কারো সঙ্গে কোনো ঝামেলা ছিল কি না, সেটা নাসির আমাদের কখনো জানাননি। মসজিদের নির্মাণকাজের জন্য প্রয়োজনীয় মালপত্র আমরা কমিটির পক্ষ থেকে কিনে দিয়েছি। আর এগুলো তিনি শুধু লাগিয়ে দেওয়ার কাজ করছিলেন। এ কাজ খুব বড় অঙ্কের টাকার না।’
নিহত নাসিরের মেয়ে নিপু জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার ইদুলপুর ইউনিয়নে। তাঁর অভিযোগ, ওই ইউনিয়ন পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান বি এম খালেকের লোকজনই তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে। চেয়ারম্যানের লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল। তিনি এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন বলে জানান।
নিহত নাসিরের ভায়রা মোমিন ভূঁইয়া জানান, ২০০৪ সালে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার ইদুলপুর ইউপির চেয়ারম্যান বিএম খালেক দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। নাসির ওই মামলার আসামি ছিলেন এবং গ্রেপ্তার হয়ে ১৪ মাস জেল খাটেন। পরে জামিনে বের হন। কিন্তু নিহত চেয়ারম্যান খালেকের লোকজন নাসিরকে বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এ ব্যাপারে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছিল।
মোমিন ভূঁইয়া আরো জানান, জেল থেকে বের হয়ে নাসির সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। রাজধানীর উত্তরায় বাসা নিয়ে থাকতেন তিনি। সম্প্রতি ঠিকাদারি কাজের সুবিধার্থে তিনি মহাখালীতে ভাড়া বাসায় ওঠেন।
বনানী থানার ওসি বি এম ফরমান আলী বলেন, ‘নাসির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের মেয়ে নারগিস আক্তার নিপু বাদী হয়ে বনানী থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এটা যে পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এ ব্যাপারে আমরা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। নাসিরকে ফোনে দেওয়া হুমকি, সিসি টিভি ক্যামেরার বিষয় মাথায় রেখে হত্যাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’