এস.এম.শাহেদুজ্জামান
লক্ষ ভেদ করার এক অদম্য ইচ্ছা ছিলো যেন তার,সেটা হোক না গোল বারের জাল যতই দূরে তিনি তার লক্ষটা ভেদ করবেন যেন যেকোনো উপায়ে। ক্যারিয়ারে ম্যাচ সংখ্যা ১৩৬৩ আর গোল সংখ্যা ১২৮১,এটা শুনে মনে হতে পারে কোন পুরোদস্তুর একজন স্ট্রাইকারের কথা বলছি কিন্তু না তিনি একজন গোলকিপারও। যদি কখনো কোচ সালদাহ্না’কে প্রিয় গোলকিপারের নাম জানতে চাওয়া হয় তাহলে তিনি এই ফুটবল জাদুকরের কথা বলেন,আর সেই মানুষ’টি হচ্ছে ‘পেলে’। বর্তমান প্রজন্মের দূর্ভাগ্য বটে কারণ তার সময়ে এই প্রজন্ম ছিলো না কিন্তু তাই বলে কী এই ব্রাজিলীয়ান কিংবদন্তীর কথা অজানা থেকে যাবে,“না”
‘জোয়াও রামোস দু নাসিকামেমো’ ছিলেন একজন ফুটবলার, কিন্তু দারিদ্রার কারণে ক্ষেতি পাওয়া হয়ে উঠেনি তার। কিন্তু তার আত্মতৃপ্তি দিতে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর পেলের জন্ম, ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরে। পেলের পূর্ণ নাম ‘এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু’, ভূল করে তার বন্ধুরা ‘পেলে’ উচ্চারণ করলে তিনি এই নামেই বড় হয়ে উঠেন। ছোট বেলা থেকে বস্তিতেই তার বেড়ে ওঠা, অভাবের সংসারে সাহায্য করতে কখনো চায়ের দোকান, কখনো ঝাড়ুদার, কিংবা কখনো জুতা মুছার কাজ করতে হয়েছে তাকে। ফুটবলের চেতনার ঘাটতি কখনোই কমেনি চারপাশে অভাবের আস্তরণ ঘিরে থাকার পড়েও। ফুটবল কেনার টাকা ছিলো না কিন্তু তাও মোজার ভিতর কাগজ পুরে ফুটবল বানিয়ে অনুশীলন করতেন।
আর সঙ্গ দিতেন বাবা, পেলের জীবনের প্রথম কোচ,ট্রেইনার,পরামর্শদাতা তার বাবা। অনুপ্রেরণা নিতে নিতে খেলা শুরু করেন পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন ছোট ছোট টিমে, ততদিনে পেলের খেলায় নিজের এক শৈলী হয়ে গিয়েছিলো। সেই শৈলী নিয়ে যোগ দিলেন ‘বাউড়ু এথলেটিক ক্লাব জুনিয়রে’,এই ক্লাবের কোচ চিলেন ‘সান্তোসের’ গ্রেট ‘ওয়াল্ড ডেইমার ড্রিপব্রিটো’।
এই দলের হয়ে ১৯৫৪ থেকে ‘৫৬ সালের মধ্যে পর পর তিনটি জাতীয় পর্যায়ের জয় এনে দেন। জয়ের পরপরই তিনি নজরে চলে আসেন ‘ব্রিটোর’, তিনি পেলে’কে গলি থেকে নিয়ে যান সান্তোস ক্লাবে এবং সান্তোসের ‘বি’ টিমে তাকে সুযোগ দেন। তখন পেলে মাত্র ১৫ বছরের এক কিশোর, ‘বি’ টিম থেকে ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে ‘সান্তোসের’ মূল টিমে জায়গা করে নেন এবং ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে ‘সান্তোসের’ হয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোল দাতার পুরুষকার অর্জন করেন। তাই নজরে পড়ে গেলেন ব্রাজিলীয়ন সরকারের এবং আইন করে পেলে’কে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো।
রিয়ালমাদ্রিত, বার্সোলনার মত জায়েন্টরা তাকে দলে নিতে চাইলেও সরকারের অনুরোধে ইউরোপীয়ান লীগে পেলের কোনদিন খেলা হয়নি। ৫৭ তে সর্বোচ্চ গোল দাতার পুরুষকার জেতার পর সেবছরই যায়গা করে নিলেন ব্রাজিলের জাতীয় টিমে। ৫৭ এর জুলাইয়ে তিনি তার প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে, হারার পরেও ব্রাজিলের একমাত্র গোল করে প্রথম আন্তর্জাতিক গোল করার রেকর্ড’টা নিজের ঝুলিতে নিয়ে নেন পেলে।১৯৫৮ তে হয়ে গেলো তার আরেক রেকর্ড, সান্তোসের হয়ে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় পেশাদারি লীগে ৫৮টি গোল দিয়ে ‘Campeau Paulista’ খেতাব এনে দেন।
একই বছর মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্কার্ডে যায়গা করে নেন,কোয়াটারে পেলের একমাত্র গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালে ওঠে। এই গোল করে বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ গোল দাতা হিসেবে রেকর্ড বুকে নাম লেখান পেলে। এরপরে সেমিফাইনামে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যট্ট্রিক করে বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ হ্যট্ট্রিক দাতার রেকর্ড করেন,ফাইনালেও দুই গোল করেন। সবমিলিয়ে ৪ ম্যাচে তার গোল দাঁড়ায় ৬টি,সেই রেশ ধরেই চারটি বিশ্বকাপে ১২টি গোল করেন এবং এখনো শীর্ষ পাঁচের মধ্যে আছেন, ৫৮ এর সেই বিশ্বকাপের সিলভার বল ও সিলভার বুট দুটোই জেতেন পেলে।
১৯৫৯ সালে আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকার ফরমেট ছিলো লীগ ভিত্তিক, ৭টি ম্যাচের টুর্নামেন্টে শেষ ম্যাচের সমিকরণ টাহ এমন ছিলো যে ব্রাজিলের জয়ি হতে ব্রাজিলকে ম্যাচ জিততে হবে আর আর্জেন্টিনার জয়ি হতে হলে ড্র করলেই হয়। ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে ব্রাজিলকে জেতাতে না পারলেও পেলে পুরো টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৮টি গোল করেন এবং সেরা খেলোয়াড়ের পুরুষকার জিতে নেন। তবে সেবছর সান্তোস ‘Paulista’ টাইটেল হারায় কিন্তু বছর না ঘুরতেই পেলেই আবার তা পুনর্ধার করেন ‘ট্যাকা ব্রাজিল’ জেতার মধ্য দিয়ে। ১৯৬২ ছিলো পেলের সবচেয়ে সাফল্যময় ক্লাব ক্যারিয়ার। এবছর সান্তোস, কোপা লিবার্তোদোরেস,ট্যাকা ব্রাজিল, ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ তিনটি জিতে পেলের নৈপুন্যে।
কিন্তু ৬২ এর বিশ্বকাপ পেলের জন্যে খুব ভালো যায়নি, ম্যাচে ইঞ্জুরিতে পড়ে বাকি টুর্নামেন্টে দর্শক হয়ে থাকতে হয় তাকে, এমনকি ৬৬ এর বিশ্বকাপও ব্রাজিলীয়ান দের কাছে একরকম দূরস্বপ্ন ছিলো। কারণ বূলগেরিয়ার ম্যাচে অত্যান্ত ফাউলের কারণে আবারো ইঞ্জুরিতে পড়তে হয় পেলেকে, আর শেষ হয়ে যায় বিশ্বকাপ মিশন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে গড়েন আরেক রেকর্ড, নিজের ফুটবল আইকন “ভ্যাস্কোডা গামা’কে” পেছনে ফেলে নিজের ১০০০ গোল সম্পূর্ণ করেন ম্যারাকান স্টেডিয়ামে একটি পেনাল্টির মাধ্যমে। আর দেখতে দেখতে চলে আসে ৭০ এর বিশ্বকাপ,প্রথমে খেলার কথা না থাকলেও পরে তাকে খেলতে হয়। প্লেমেকার তকমা’টাও পেয়ে যান এই বিশ্বকাপ থেকেই,ফাইনাল ম্যাচে ইতালির বিরুদ্ধে প্রথম গোল’টি সহ পুরো টুর্নামেন্টে চারটি গোল আর সাতটি আনুকূল্য করে সেই বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন।
নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন এই কিংবদন্তি ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই। ইতি টানাই বাকি ছিলো ক্লাব ক্যারিয়ারের, যেটি করেছিলেন বেশ কয়েক বছর পরে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ১৯ বছরের ক্লাব সান্তোস ছেড়ে দেন। ১৯৭৬ সালে যোগ দেন ‘নিউইয়র্ক কসমসে’ তবে বেশীদিন থাকেননি সেখানে,১৯৭৭ সালে কসমসের হয়ে ক্লাব যাত্রা শেষ করেন। ১৯৭৭ এর পহেলা অক্টোবর সান্তোস এবং কসমসের হয়ে নিজের শেষ ম্যাচ খেলেন, এই ম্যাচে তিনি নিউইয়র্ক অর্ধেক সময় কসমসের আর অর্ধেক সময় সান্তোসের হয়ে খেলেন যেখানে কসমস ২-১ এ এই ম্যাচ জিতে যায়। এরপর ফুটবলে আর পেলে’কে দেখানা গেলেও তিনি ফুটবলের সাথেই যুক্ত ছিলেন, ব্রাজিল ফুটবলের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখেন তিনি। ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছা দুত হন তিনি পাশাপাশি পেয়েছেন ব্রাজিলের গোল্ড মেডেল, ব্রিটিশ রাজদরবার থেকে নাইট উপাধি, বিবিসি থেকে আজীব সম্মাননা, International Federation Of Football History & Statistics (IFFHS) থেমে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার, International Olympic Committee And Reuters News Agency থেকে শতাব্দীর সেরা অ্যথলেট এবং ২০১০ সালে নিউইয়র্ক কসমসের সম্মানিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবধ্য হওয়া পেলে চার কন্যা ও দুই ছেলের জনক।