তন্ময় অনিক
বাংলার কৃষি সমাজের কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশ হলো, পশুপালন। যে ধারা সুদূর অতীত থেকে আজও বহমান। এর মাধ্যমে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে অবদান রাখা সম্ভব বাণিজ্য খাতে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন যথার্থ পরিচর্যা। পশুপালন পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, প্রয়োজনীয় ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ। আর এসকল খাদ্যের অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস, সবুজ ঘাস।সবুজ ঘাসে দেহ গঠনকারী আমিষের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান সংরক্ষিত থাকে। ফলে গবাদি পশুর ক্ষেত্রে সবুজ ঘাসের পুষ্টিমান অনেক বেশি। উপযুক্ত আবহাওয়া এবং ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের প্রায় সকল এলাকায়ই প্রাকৃতিকভাবে সবুজ ঘাস জন্মে। কিন্তু পশুখাদ্যের জোগান দিতে এর তার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। তাই প্রয়োজন হয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ঘাসের চাষ। সাধারণত উপযুক্ত জমি নির্ধারণ করে কর্ষণের পর ঘাসের বীজ ছড়িয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয় ঘাস বা অন্যান্য শস্য। কিন্তু ঘাস চাষের এই প্রচলিত ধারণায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে হাইড্রোফনিক(মৃত্তিকাবিহীন জল চাষ বিদ্যা) ফডার পদ্ধতি।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটি নয়, শুধু পানি ব্যবহার করেই ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে শুরু হয়েছে এই পদ্ধতি এবং সহায়ক দিকের কথা বিবেচনা করে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে অন্যত্র। ইতিমধ্যে হাইড্রোফনিক(মৃত্তিকাবিহীন জল চাষ বিদ্যা) ফডার নামক এই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যশোরেও এবং প্রত্যক্ষ হচ্ছে এর সুফল। যার সূচনা ঘটেছে যশোরের একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে। তিনি যশোর সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের ‘কৃষি বাড়ি’ খামারের একজন অংশীদার। তার এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি চ্যানেল আগামীকে বলেন, “ইন্টারনেট থেকে হাইড্রোফনিক ফডার সম্পর্কে জেনেছিলাম। এরপর কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই ইউটিউবে ভিডিও দেখে খামারের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করি।” তবে হাইড্রোফনিক(মৃত্তিকাবিহীন জল চাষ বিদ্যা) ফডার এর বিশেষত্ব শুধু উৎপাদন পদ্ধতিতে নয়, কার্যকারিতায়ও। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে খামারের ভেড়ার জন্য দৈনিক প্রায় ২০ কেজি খাদ্য উৎপাদন করেন তারা। তবে শুধু ভেড়া নয়, গরু, ছাগল, খরগোস এবং অন্যান্য পশুর দৈনিক পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সক্ষম এই খাদ্য। ‘কৃষক বাড়ি’র সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ হন ‘যশোর ডেইরি’র স্বত্বাধিকারী রিয়াজ মেহমুদ খান। তিনিও তার খামারে এ পদ্ধতি ব্যাবহার করে ৩৩ টি গরুর জন্য উৎপাদন করছেন দৈনিক প্রায় ১০০ কেজি খাদ্য। ট্রে’র ভেতর মাটি ছাড়াই শুধু পানি ছটিয়ে ঘাসের চাষ করা হচ্ছে বলে জানান, খামারের কর্মীরা। তবে প্রয়োজন হয় নিবিড় পরিচর্যা। হাইড্রোফনিক(মৃত্তিকাবিহীন জল চাষ বিদ্যা) ফডার পদ্ধতি সম্পর্কে উৎসাহিত হয়ে বলেন, “বর্তমান সময়ে পশুকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বাজারে প্রাপ্ত দানাদার খাদ্যের মানদণ্ড সবসময় ঠিক থাকে না। কিন্তু এ পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন বেশ সহায়ক এবং লাভজনক।” এর মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্য ব্যবহারে গত মাসে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে খামারের গরুর দুধের ঘনত্ব। একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি দূর হচ্ছে আবাদ জমির সংকট। কারণ সনাতন পদ্ধতিতে ৫ বিঘা জমিতে যে পরিমাণ ঘাস উৎপাদন করা হয়, হাইড্রোফনিক প্রযুক্তিতে তা সম্ভব মাত্র ৩০০ বর্গফুটের একটি টিনশেডের ঘরেই!
‘কৃষক বাড়ি’ ও ‘যশোর ডেইরি’ এর এই কার্যক্রম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে অনেকেরই। আর কার্যকারিতার কথা বিবেচনা করে আগ্রহী হচ্ছেন যশোর শহরের আরো অনেক খামারি এবং কৃষি উদ্যোক্তা। হাইড্রোফনিক(মৃত্তিকাবিহীন জল চাষ বিদ্যা) নিয়ে ইতিমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন, রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জাহিদুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সাইন্সেস (বাস) ও ইউএসডিএ’র একটি প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশের চাষিদের জন্যে হাইড্রোফনিককে লাভজনক করতে কাজ করছেন। এই বিশেষ চাষ পদ্ধতিতে মোকাবেলা করা যাবে বর্তমান কৃষি সমস্যাগুলোর অনেকাংশ। উৎপাদন বৃদ্ধিপাবে ৯ গুন। শহুরে জীবনে বাসা বাড়িতে শখ এবং প্রয়োজন উভয় ক্ষেত্রেই নতুন মাত্রা আনবে এই আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি। শুধু তাই নয়, ভূমিকা রাখবে সৌন্দর্যবর্ধনেও।