ইশতিয়াক আহম্মেদ
আজ বছরের শেষ উল্কাপাত আর্সিডসের পিক টাইম! অর্থাৎ, আজকে এই বছরের শেষ উল্কাপাত আর্সিডসের সর্বোচ্চ উল্কা দেখা যাবে! কয়েকদিন আগেই আমরা জেমিনিডস উল্কাপাত দেখেছিলাম। সেই হিসেবে এই মাসের দ্বিতীয় উল্কাপাত এটি। ডিসেম্বরের ১৭ থেকে ২৫ তারিখের ভিতরে এই উল্কাপাত হয়। ডিসেম্বরের ২২ তারিখ হল এই উল্কাপাতের পিক টাইম। পিক টাইম হলেও ঘণ্টায় মাত্র ৮/১০ টি উল্কা দেখা যাবে, যেখানে আমরা জেমিনিডস উল্কাপাতে ১২০ টি পর্যন্ত উল্কা দেখেছি, সেই তুলনায় সংখ্যা বিবেচনায় আজকের উল্কাপাত অনেক কম। তবে আশার কথা হল এই উল্কাগুলো কিছুটা আকারে বড় হওয়ায় অগ্নিগোলকের মত মনে হবে! মনে হবে যেন মাটিতে পড়ছে। গতকালও এমন এক উল্কা দেখার ঘটনা জানা গেছে। লঘু সপ্তর্ষি (Ursa Minor) নক্ষত্রমণ্ডলের প্লবঙ্গ (Kochab) নক্ষত্রের নিকটে এই উল্কাপাত হবে। আকাশের কোনদিকে কোন তারার নিকটে তাকাতে হবে এই উল্কাপাত দেখার জন্য তা জানার আগে চলুন জেনে নেই, উল্কাপাত কি ?
গ্রাম বাংলায় উল্কাপাতকে বলা হয় তারা খসা। আগে সাধারণ মানুষ মনে করতো আকাশের তারাই কোনো কারণে খসে পড়লে, তখন আকাশে এই ‘তারা খসা’ দেখা যায়। অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাসে মনে করেন, ফেরেস্তারা শয়তানকে যখন চাবুক মারে তখন এই আলো দেখা যায়। হিন্দুরা মনে করেন ব্রহ্মার ইচ্ছেয় এমনটি হয়!জ্যোতির্বিদদের ভাষায়, মহাকাশে নানা ধরণের ছোটো ছোটো মহাকাশীয় বস্তু ভেসে বেড়ায়। এই বস্তুগুলো যখন কোন গ্রহ-নক্ষত্রের কাছাকাছি চলে আসে, তখন এদের আকর্ষণে বস্তুগুলো এদের দিকে চলে আসে। এই ঘটনা মহাকাশের সকল গ্রহ-নক্ষত্র এমন কি চাঁদের মতো উপগ্রহেও ঘটে থাকে। পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা অধিকাংশ উল্কাপিণ্ডের উৎস ধূমকেতু। ধুমকেতু হল ধুলো, বরফ ও গ্যাসের তৈরি এক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু। ধূমকেতু একটি ক্ষুদ্র বরফাবৃত সৌরজাগতিক বস্তু যা সূর্যের খুব নিকট দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময় দর্শনীয় কমা (একটি পাতলা, ক্ষণস্থায়ী বায়ুমন্ডল) এবং কখনও লেজও প্রদর্শন করে । ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসের ওপর সূর্যের বিকিরণ ও সৌরবায়ুর প্রভাবের কারণে এমনটি ঘটে। ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস বরফ, ধূলা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথুরে কণিকার একটি দুর্বল সংকলনে গঠিত। প্রস্থে কয়েকশ মিটার থেকে দশ কি.মি. এবং লেজ দৈর্ঘ্যে কয়েকশ কোটি কি.মি. পর্যন্ত হতে পারে । অর্থাৎ , চলার পথে এটি এর লেজ থেকে নির্গত বরফীয় পাথর জাতীয় বালির ডানা থেকে মটর আকৃতির অনেক অংশ ফেলে যায় ।
পৃথিবী তার কক্ষপথে চলার সময় বিভিন্ন ধূমকেতুর কক্ষপথের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তখন ওই সকল ধূমকেতুর ছোটো ছোটো অংশ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে। পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা এই বস্তুগুলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন বায়ুমণ্ডলের সাথে এদের সংঘর্ষে এরা উত্তপ্ত হয়ে উঠে এবং একসময় তাতে আগুন ধরে যায়। রাতের আকাশে এই জ্বলন্তু বস্তুগুলোকেই উল্কা নামে অভিহিত করা হয়। আজকে রাতের লঘু সপ্তর্ষি মণ্ডলে এই আর্সিডস উল্কাপাত দেখা যাবে বিধায় এমন নামকরন করা হয়েছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল ও লঘু সপ্তর্ষিমণ্ডলে এই একমাত্র উল্কাপাত দেখা যায় বিধায় শুধু আর্সিডস বলেই একে ডাকা হয় । 8P/Tuttle নামক ধূমকেতু থেকে আজকের এই আর্সিডস উল্কাপাতের উৎস। অর্থাৎ, 8P/Tuttle নামক ধূমকেতু যখন পৃথিবীর কক্ষপথ অতিক্রম করেছিল তখন এর লেজ থেকে নির্গত অংশই আজকের উল্কাপাতের জন্য দায়ী। গত জেমেনিডস উল্কাপাতে আমরা মাত্র ২ সেকন্ড স্থায়ীত্বের উল্কা দেখেছি। কিন্তু আর্সিডসের এই উল্কাপাতের জন্য দায়ী বস্তুগুলি প্রায় মটরদানার আকৃতির! তাই যখন এটি বায়ুমণ্ডলের সাথে সংঘর্ষে জ্বলে উঠবে মনে হবে যেন আগুনের গোলা! আর তাই এটির স্থায়িত্বও বেশি। তবে সংখায় অনেক কম তা আগেই বলেছি।
শুধু সংখ্যাগতভাবে না , এর উৎপত্তিস্থলের দিকে তাকানোও বেশ কষ্টসাধ্য। একে দেখা যাবে লঘু সপ্তর্ষি মণ্ডলের প্লবঙ্গ নক্ষত্রের দিকে। এই নক্ষত্র অধিকাংশ সময় উত্তর দিকে দিগন্তের নিকটে অবস্থান করে! চলুন এই নক্ষত্রকে খুজে বের করার উপায় জেনে নেই। তার আগে আমাদের চিনতে হবে ধ্রুবতারা বা পোলারিসকে। পোলারিসকে কে না চিনে! অবস্থান বিবেচনায় ভুমি থেকে কল্পিত রেখার ৩৫-৪৫ ডিগ্রি কোনে উত্তরে তাকালে যে উজ্জ্বল তারা দেখতে পাবেন সেটাই হল পোলারিস। উত্তর বরাবর সোজা তাকালে এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে সহজেই দেখা যায়। ৩৪৬-৪৩৩ আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত পোলারিস মুলত বেশ কয়েকটি নক্ষত্রের মিলিত রূপ। অর্থাৎ পোলারিসকে পৃথিবী থেকে একটি মাত্র নক্ষত্র মনে হলেও এটি মুলত কয়েকটি নক্ষত্রের মিলিত ব্যাবস্থা। এর আপেক্ষিক উজ্জ্বলতা ১.৯৭ । অর্থাৎ এটি আকাশের সহ উত্তর আকাশের অন্যতম একটি উজ্জ্বল তারা । এটি লঘু সপ্তর্ষি মণ্ডলের সবচাইতে উজ্জ্বল তারা বিধায় এর দাপ্তরিক নাম Alpha Ursae Minoris । অনেকে হয়ত একটা বিষয় জানেন না যে, পোলারিস কিন্তু রাতের আকাশে অবস্থান পরিবর্তন করে না। অর্থাৎ রাত বাড়ার সাথে সাথে অন্য তারারা অবস্থান পরিবর্তন করলেও পোলারিস এই একই যায়গায় স্থির থাকে। এর কারন হল এটি পৃথিবীর অক্ষাংশ বরাবর উত্তরে অবস্থান করছে। দুইমেরুর মধ্যবর্তী কল্পিত রেখাকে অক্ষাংশ বলে। আর তাই আমরা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে একে স্থির দেখি, আর অন্য তারাদেরও একে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিন করতে দেখি ।
আর লঘু সপ্তর্ষির দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম তারাই হল আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্লবঙ্গ! ইংরেজি kochab নামের এই তারকাটির দাপ্তরিক নাম Beta Ursae Minoris । ১৩০.৯ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই তারাতির আপেক্ষিক উজ্জ্বলতা ২.০৮ । একে রাত ১২ টার আগে দেখতে পাওয়া বেশ কষ্টকর। কারনটি হলো এটি প্রায় একদম দিগন্তে অবস্থান করেছে। তাই শুধু সংখ্যা বিবেচনায় না, অবস্থানের জন্যও এই উল্কাপাত দেখা বেশ কষ্টসাধ্য। কেবল উঁচু বিল্ডিং বা ফাঁকা মাঠে অথবা দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের জমি থেকে এই আর্সিডস উল্কাপাত দেখা যাবে। পোলারিসের অনেক নিকটে অবস্থান করার প্লবঙ্গ তারকাটিও অতি দ্রুত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যায়। রাত ১২ টার দিকে প্লবঙ্গকে পোলারিসের উত্তর পূর্বে দিগন্তের নিকট দেখা যাবে। এসময় প্লবঙ্গ তারকার প্রায় উপরেই আর্সিডস উল্কাপাত দেখা যাবে।
রাত ২-৩ টা হল আজকের উল্কাপাতদেখার সবচাইতে ভাল সুযোগ। এ সময় পোলারিস থেকে সোজা পূর্বে প্লবঙ্গ অবস্থান করবে বিধায়, নক্ষত্রটিকে খুঁজে পাওয়া ও দেখতে সুবিধা হবে। আর এই নক্ষত্রের উপরের দিকে সামান্য বাম দিকে আর্সিডস দেখা যাবে। নিচে রাত ১২ টা ও রাত ২ টার উল্কাপাতের উৎপত্তিস্থলকে হলুদ বৃত্ত দিয়ে চিহ্নিত করা হল। আজ সংখ্যা ও অবস্থান বিবেচনার জন্য কেবল ভাগ্য ভাল থাকলেই উল্কা দেখতে পাবেন। তবে এই শীতের রাত ধৈর্য আকাশপ্রেমীদেরকে এই সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হতে আশাকরি বাঁধা প্রদান করবেনা।