ইশতিয়াক আহম্মেদ
ম্যাক্স বর্ন ১৮৮২ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্রেস্লাউ (বর্তমানের Wrocław, পোল্যান্ড), তৎকালীন জার্মান সাম্রাজ্যের প্রুশিয়ার রাজতন্ত্রের সিলেসিয়া রাজ্যে, এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ব্রেসলাউ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভ্রূণতত্ত্ব ও শরীরতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন। ফ্রাংকফুট, গ্রোনিংগেন,জুরিখ,এডিংবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গনিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন! আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব তখন মহাশূণ্য সম্পর্কে মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল। তখন তারই আরেক ঘনিস্ট বন্ধু ম্যাক্স বর্ন কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে দেখালেন যে অতিপারমানবিক কণাদের জগতও কম রহস্যজনক না ।
ম্যাক্স বর্ন তার সময়কার সেরা বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করেন, যাদের মধ্যে ভের্নার হাইজেনবের্গ, ভোল্ফগাং পাউলি, এনরিকো ফের্মি ও পল ডিরাক অন্যতম। তিনি কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের উপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রকাশ করেন। এরপর তিনি তরঙ্গ ফাংশনের একটি পরিসংখ্যানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যার জন্য ১৯৫৪ সালে তাঁকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তার এই পরিসংখ্যানিক ব্যাখ্যা বর্নের নীতি বা Born rule নামে পরিচিত! এই নীতি দ্বারা কোয়ান্টাম ব্যবস্থায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে অতিপারমানবিক কণাদের অবস্থান নির্ণয় করা যায়! এই নীতি কোয়ান্টাম বলবিদ্যাসহ পদার্থবিজ্ঞানে খুবই গুরত্বপূর্ণ যা অতিপারমানবিক কণাদের জগত শাসন করে। মহাবিশ্বের জন্ম থেকে পরিনতি, নক্ষত্রের কেন্দ্রের ফিউশন থেকে আলোর গতিপথ প্রায় সর্বক্ষেত্রে আমরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপর নির্ভরশীল !
বর্নের এই নীতি প্রকাশের পূর্বে কণা পদার্থবিদেরা ভাবতেন কণাদের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য অনেক অনেক সূক্ষ্ম পরীক্ষা ও অসংখ্য বড় বড় সমীকরণ প্রতিপাদন করতে হবে। কিন্তু বর্ন দেখালেন যে আপনি শুধু ম্যাট্রিক্স ও গনিতের সম্ভাব্যতার কিছু সূত্র ব্যাবহার করে অতিব সহজে কণাদের সম্ভাব্য অবস্থান নির্ণয় করতে পারবেন ! ম্যাট্রিক্সের সংজ্ঞা বলতে আমরা জানি,”আয়তাকারে সারি ও কলামে বা শুধু সারিতে বা শুধু কলামে সাজানো ও বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ সংখ্যাগোষ্ঠি!” এই নীতির মৌলিক উদ্দেশ্য হল সম্ভাবনার সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে কনা খুজে বের করা! প্রতিটি কণারই একটা নির্দিষ্ট পরিচয় আছে যাকে একটি সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই সমীকরণকে ওয়েভ ফাংশন বলে!
কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে একটি ওয়েভ ফাংশন কোনো সিস্টেমের কোয়ান্টাম অবস্থার বর্ণনা দেয়। ওয়েভ ফাংশন অবস্থান আর সময় এর উপর নির্ভরশীল একটা জটিল সংখ্যা। একে Ψ দ্বারা প্রকাশ করা হয়।শুধু ওয়েভ ফাংশন এর বাস্তব কোন ব্যাখ্যা নেই। তবে ওয়েভ ফাংশন এর পরম মান এর বর্গের(|Ψ|2) বাস্তব ব্যাখ্যা রয়েছে। |Ψ|2 কে সম্ভাব্যতা ঘনত্ব বলে। সহজভাবে বলতে, আপনি যদি অনেক গুলো সম্ভাবনা ঘনত্ব বের করে একটা সেট গঠন করতে পারেন , তাহলে আপনি কোন প্রকার সরাসরি পরমাপ ছাড়া কণাদের আপাত অবস্থান নির্ণয় করতে পারবেন!
উল্লেখ্য, তরঙ্গ(ওয়েভ, wave) হল কোনো মাধ্যমে কণার পর্যায়বৃত্ত আন্দোলন। এই তরঙ্গ বা ওয়েভ বিভিন্ন ধরণের হয়। যেমনঃ জল তরঙ্গ, শব্দ তরঙ্গ। বিভিন্ন তরঙ্গের মধ্যে বিভিন্ন পরিমাপের পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন জল তরঙ্গের ক্ষেত্রে জলের উচ্চতার পরিবর্তন হয়, শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রে চাপের পরিবর্তন হয়। তেমনি, যে পরিমাপের পরিবর্তন বস্তু তরঙ্গ গঠন করে তাকে ওয়েভ ফাংশন বলে। একটু আগেই জেনেছি কোয়ান্টাম মেকানিকাল জগতে ওয়েভ ফাংশন দ্বারা কণার অবস্থান জানা যায়। এইটুকু বুঝতেই যদি আপনার মাথা খারাপ হয়ে যায় , তবে ভয় পাবেন না। ফোর্বস মাগাজিন অনুযায়ী অনেক বড় বড় পদার্থবিদও নাকি বর্নের এই নীতি বুঝতেন না। তবে মুক্তচিন্তা ও অধিকারবাদী এবং একই সাথে ইহুদি বংসদ্ভুত হওয়ায় হিটলার বর্নের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি সিভি রামনের সাথে ১৯৩৫ সালে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সাইন্সেও কাজ করেছেন। জীবনের বেশ কিছুটা সময় তিনি ভবঘুরের মত এই দেশ থেকে ঐ দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন। অবশ্য পরবর্তীতে স্বীয় দেশে নাগরিকত্ব ফেরতও পেয়েছেন। জার্মানি সরকার তার সম্মানে Max-Born-Institut für Nichtlineare Optik und Kurzzeitspektroskopie নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেছে !