পার্বত্য অঞ্চলে আবারও বেড়েছে খুনোখুনি। সর্বশেষ মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে শক্তিমান ও তপনজ্যোতি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত হয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা হচ্ছে এসব অস্ত্রের উৎস নিয়ে। দুই দশক আগে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়, চুক্তি বিরোধিতাকারীদের একটি অংশ ঘোষণা দিয়েও অস্ত্র জমা দেয়নি। ধারণা করা হয়, অন্য অংশেরও সবাই অস্ত্র জমা দেয়নি। তবে বর্তমানে যেসব অস্ত্র ব্যবহূত হচ্ছে, তখন পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন শান্তি বাহিনীর হাতে এমন অস্ত্র ছিল না।
বান্দরবানের বিমল শান্তি চাকমা একসময় শান্তি বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ারও প্রায় এক যুগ আগে ১৯৮৫ সালে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। তিনি বলেন, তাদের সময়ে শান্তি বাহিনী মূলত কার্বাইন (এসএমজি), এলএমজি, পাইপগান, পয়েন্ট টুটু, দেশি পিস্তল ও বন্দুক ব্যবহার করত। শান্তি বাহিনী থেকে আশির দশকে আত্মসমর্পণকারী উশৈনু মারমাও প্রায় অভিন্ন তথ্য দেন। তিনি বলেন, সে সময় শান্তি বাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দুটি দলে বিভক্ত হয়। স্থানীয়ভাবে বাটি ও লম্বা গ্রুপ নামে পরিচিত শান্তি বাহিনীর বাটি দলের সদস্য ছিলেন উশৈনু। ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে তাদের দলের ২৩৩ সদস্যের সবাই একসঙ্গে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি বলেন, ওই সময়ে অস্ত্রগুলো মূলত ভারতের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে ক্রয় করা হতো। মিয়ানমার থেকে তখন খুব একটা অস্ত্র সংগ্রহ করা হতো না।
বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রসন্ন তঞ্চঙ্গ্যাও ১৯৮৫ সালেই শান্তি বাহিনী ছেড়ে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে যেভাবে অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, তাতে অস্বীকার করার উপায় নেই- পাহাড়ে অস্ত্র রয়ে গেছে এবং নতুন নতুন অস্ত্র আসছে। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য যে নিজেদের অস্ত্র এখন নিজেদের বিরুদ্ধেই ব্যবহূত হচ্ছে। চুক্তির আগপর্যন্ত যে আন্দোলনে পাহাড়ের মানুষের অধিকারের বিষয়টি ছিল প্রধান, তা-ই এখন দুঃখজনক মোড় নিয়েছে।’
বিলুপ্ত শান্তি বাহিনীর এই তিন সদস্যের সঙ্গে আলাপে ধারণা পাওয়া যায়, পাহাড়ে ব্যবহূত হচ্ছে অত্যাধুনিক অনেক অস্ত্র, যা সাম্প্রতিককালেই বাহিনীগুলো সংগ্রহ করেছে। খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন টিটু বলেন, পাহাড়ের পরস্পরবিরোধী চারটি সংগঠনের সন্ত্রাসীদের হাতে ক্ষুদ্র অস্ত্রের পাশাপাশি অনেক ভারী ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে। বড় অপারেশনে চায়নিজ রাইফেল, একে-৪৭, একে-২২, এসবিএল, শুটারগান ও জি-ত্রির মতো অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। এই এক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, গুপ্ত হত্যায় ক্ষুদ্র অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে থাকে ওই গ্রুপগুলো।
শক্তিমান চাকমা নিহত হওয়ার সময় নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদেই ছিলেন এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়, হত্যাকারীদের সঙ্গে কিছু ক্ষুদ্রাস্ত্রও ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানান, মুহূর্তেই অনেক গুলির শব্দ পেয়েছেন তিনি। হত্যাকারীরা এসেছিল মোটরসাইকেলে এবং পালিয়ে যাওয়ার সময় উল্লাস করেছে তারা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া তিন সন্ত্রাসীর হাতে বাজারের ব্যাগ ছিল। প্রথমে একজন সামনে থেকে শক্তিমানকে গুলি করে এবং অন্য দু’জনও দু’দিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে দ্রুত পালিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্র সম্পর্কে ধারণা পেতে চাইলে র্যাব-৭ প্রধান লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা আধুনিক মানের হালকা অস্ত্র এবং এ ধরনের অস্ত্র সাধারণ বাজারের ব্যাগের ভেতরে অনায়াসে লুকিয়ে রাখা যায়।
চার ভাগে বিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতে গত ৩ মে খুন হন সংস্কারপন্থি জেএসএসের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। পরদিন শক্তিমানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার পথে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের প্রধান তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ আরও চারজন আততায়ীর গুলিতে মারা যান। তপনজ্যোতি হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে। বেতছড়ির টেঙ্গারচর এলাকায় কথা বলার একপর্যায়ে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই যুবক বলেন, ঘর থেকে তিনি কাজের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ ব্রাশফায়ারের মতো মুহুর্মুহু শব্দ শুনতে পান তিনি। এর কিছু সময় পর কিছুপথ হেঁটে এসে দেখেন, রাস্তার ধারে টিলার সঙ্গে সাদা রঙের একটি মাইক্রো উল্টে রয়েছে। ভেতরে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা।
নানিয়ারচর থানার ওসি আবদুল লতিফ জানিয়েছেন, খোঁজখবর নিয়ে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তা থেকে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়- শক্তিমান, তপনজ্যোতিসহ ছয় খুনের ঘটনায় ব্যবহূত হয়েছে এসএমজি ও একে-৪৭-এর মতো ভারী অস্ত্র।
কোথা থেকে আসছে এসব অস্ত্র- জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্নেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মূলত ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের অরক্ষিত সীমান্ত পথ দিয়ে পাহাড়িদের হাতে অস্ত্র আসছে। পাহাড়ে যে চাঁদাবাজি হয়, সেই অর্থই ব্যয় করা হয় অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হওয়ার সময় পার্বত্য অঞ্চলে চিফ সিকিউরিটি নেগোসিয়েশন অফিসার হিসেবে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করা নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতের সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত সাত রাজ্যের অরক্ষিত সীমান্ত পথই পাহাড়ে অস্ত্র আসার মূল পথ। সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন রাজ্যে মনিপুর লিবারেশন আর্মি, উলফাসহ বিভিন্ন সংগঠন এখনও সক্রিয়। তাদের নিজস্ব ব্যাটালিয়নও রয়েছে। আবার নাগাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে কাচিং ইনডিপেনডেন্ট আর্মি ও সান ন্যাশনাল আর্মির। বাংলাদেশ সীমান্তেও তাদের আনাগোনা রয়েছে। মূলত এদের কাছ থেকে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পাহাড়ে অস্ত্র আসে।’ যোগাযোগ করা হলে র্যাব-৭ প্রধান লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদও অভিন্ন মন্তব্য করে বলেন, ‘ভারত ও মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্তপথে দেশে অস্ত্র ঢোকে। বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে আসা একে-৪৭সহ বেশ কিছু অস্ত্র আমরা উদ্ধারও করেছি।’
তিন পার্বত্য জেলার সীমান্তবর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার। বান্দরবানের সঙ্গে রয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের সীমানা। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির সঙ্গে ভারতের সীমানা। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো খুবই দুর্গম। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সীমান্তবর্তী এলাকা। এই উপজেলাগুলোর সীমানায় ভারত ও মিয়ানমারের ভেতরে অবস্থান করছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। বান্দরবান বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইকবাল করিম বলেন, দুর্গম পাহাড়ি পথে দুর্গমতার কারণে লাগাতার প্যাট্রোলিংয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এলাকা দুর্গম হওয়ার কারণে আমাদের অগোচরে সন্ত্রাসীরা সুযোগ নিলেও নিতে পারে।