আসীর মুরাদ, বিশেষ প্রতিবেদক
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অকুতোভয় সূর্য সন্তানের নাম শহীদ রুমী; পুরো নাম শাফী ইমাম রুমী। তিনি ১৯৫২ সালের ২৯শে মার্চ সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তাঁর ৬৫তম জন্মবার্ষিকী। রুমী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর পিতার নাম শরীফুল আলম ইমাম, যিনি পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। আর মা জাহানারা ইমাম মুক্তচিন্তার অধিকারী একজন লেখিকা, যিনি ‘শহীদ জননী’ হিসেবে পরিচিত। রুমী ছিলেন তাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। রুমীকে নিয়ে মা জাহানারা ইমামের অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলেও কবি জালাল উদ্দিন রুমীর মত জ্ঞানী ও দার্শনিক হবে, তাই মা ছেলের নাম রেখেছিলেন রুমী।
ছাত্রজীবনে রুমী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় ঢাকার আজিমপুরে একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে। তিনি ১৯৬৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে স্টার মার্কস নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডে ৩য় স্থান অধিকার করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে স্টার মার্কস নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি আমেরিকার Illonois Institute of Technology (IIT) তে ভর্তি হন। তবে যুদ্ধে যোগদানের কারণে সেখানে আর যাওয়া হয়নি তাঁর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে বিশেষ অনুমতিতে ক্লাস করেছেন তিনি।
বাবা-মায়ের সঠিক নির্দেশনায় রুমী হয়ে উঠেছিলেন সাহসী, স্পষ্টবাদী ও দৃঢ়চিত্তের অধিকারী। সচেতন পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে তিনি ছোটবেলা থেকেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেমী মনোভাব লালন করে বেড়ে উঠেন। বই পড়ার অভ্যাস ছিল তাঁর যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আন্দোলনের ইতিহাসগুলো তিনি জানতেন। যার ফলে নিজের দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং মাকে যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়ে এই বলে রাজি করান যেঃ “আম্মা, দেশের এ রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা?”মা জাহানারা ইমাম এর প্রতিউত্তরে তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে বলেনঃ
“কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগীতার উজ্বল তারকা রুমী কোনদিনই বিতর্কে হারে নি প্রতিপক্ষের কাছে, আজই বা সে হারবে কেন? আমি দুই চোখ বন্ধ করে বললাম- না, তা চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।” ১৯৭১ সালের ২৯মার্চ রুমীর ১৯তম জন্মদিনে বাবা-মায়ের আশীর্বাণীটি ছিলঃ “এই অশুভ সময়ে তোমার শুভ জন্মদিনে চিরাচরিত যে আশীর্বাণী: ‘বড় হও, সফল হও, সুপ্রতিষ্ঠিত হও’ তা উচ্চারণ করতে পারলাম না। তার বদলে শুভ আশীর্বাণী উচ্চারণ করছি: বজ্রের মতো হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠো, দেশের অপমান দূর করো, দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসার দুরূহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো।”
১৯৭১ সালে রুমী ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ, গৌরবময় ও অসামান্য অবদান রাখেন। কিন্তু ২৯শে আগস্ট রাতে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে আসলে রুমীকে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে তাঁর বাবা, ছোট ভাই, বন্ধু ও চাচাতো ভাই সহ পাকহানাদাররা ধরে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। পরে পরিবারের অন্য সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হলেও রুমীকে আর ছাড়া হয়নি। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল। আশ্চর্য রকম সত্যি এই যে, নৃশংস নির্যাতন সহ্য করেও বীর রুমী হানাদার বাহিনীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করেন নি। এমন বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যেইত কবি লিখেছেন-
“ এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার রুমীকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। তরুণ প্রজন্মের আদর্শ শহিদ রুমীর স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে থাকবে চির অটুট, চির উজ্বল ও চির ভাস্বর হয়ে। কেননা মৃত্যুহীন প্রাণ নিয়েই যে তিনি জন্মে ছিলেন।