Monday, April 28, 2025
27 C
Dhaka

এক নজরে বাংলা নববর্ষ: আবহমান বাংলার ও বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব

ইভান পাল

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জন্য আমাদের মাতৃভাষা স্বীকৃতি পেয়েছে সমগ্র বিশ্বের কাছে। আর আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা হওয়ার কারণে হয়েছি বাঙ্গালি জাতি। আবার ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ আর দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য আমাদের এই বাঙ্গালিয়ানাটা শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে পুরো বিশ্বের কাছে। পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি।।

তো, পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা বাঙ্গালি। আমাদের ও কিছু আনন্দ বা উৎসবের বা বিনোদনের দরকার আছে।

আমাদের প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত জীবনে কিছুটা সময় আনন্দ বা উৎসবে যদি ব্যয় করি তাহলে শরীর যেমন ভালো থাকে, ঠিক তেমনি মনেও কোন প্রকার জং ধরে না।

কিন্তু কে বলে আমরা উৎসব অনুষ্ঠান করি না। বা আমাদের এই বাংলায় কোন উৎসব অনুষ্ঠান হয় না?

ভিন দেশী বহু পর্যটক এদেশে এসেছেন। তারা বলেছেন, বাঙ্গালি মানেই– “বার মাসে তেরো পার্বণ”।।

ঠিক তাই, আমাদের এই বাঙলায়, বাঙলার প্রতিটি ঘরে ঘরে বার টা মাসে শুধু উৎসব আর উৎসব লেগেই থাকে।

এই যেমন: পহেলা বৈশাখ, তারপর আসে নবান্ন, ঈদ পুজো তো থাকেই। সাথে আবার পিঠা পুলির উৎসব থাকে, আবার কখনো বর্ষা ঋতুকে আহ্বান জানানোর জোর ব্যস্ততা। এদিকে আবার বৌদ্ধ পুর্ণিমাতে ফানুস উড়ানো, তারপর থাকে বসন্ত উৎসব আবার থাকে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব। আরো কত্ত যে উৎসব আছে আমি বলে শেষ করতে পারবো না।। আর তাই ই ভিন দেশীরা বলে,, এই বাংলা বার মাসে তেরো উৎসবের দেশ। যদি ও দেশ টি খুব ছোট্ট। কিন্তু তাতে কি, এই ছোট্ট দেশটিতে

ধনী, দরিদ্র, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল ধর্মের মানুষ মিলে হাসি আর আনন্দে এই বার মাসে তেরো পার্বণ কাধেঁ কাধঁ মিলিয়ে উদযাপন করি। এ আমাদের প্রাণের বাংলা, আমাদের বাংলাদেশ।

এই বাঙ্গালিদের ই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে, পহেলা বৈশাখ। যাকে আমরা বলি– “আমাদের প্রাণের উৎসব”।

গতকাল ই বিদায় নিয়েছিল ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। আর আজ সাজ সাজ রব নিয়ে প্রকৃতির রাজ্যে আসল নতুন বছর ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। বাংলা বার মাসের প্রথম ঋতু বা প্রথম মাস হল– বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ হচ্ছে– বাংলা সনের প্রথম দিন। যেহেতু এটি বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন তাই ই এটিকে বলা হয়– নববর্ষ বা বাংলা নববর্ষ।

বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে একটু যদি বলি তবে ফিরে যেতে হয়, আজ থেকে বহু বছর আগে। যখন এদেশে রাজা -বাদশারা শাসন করতেন সেই সময়ে।

এদেশীয় হিন্দুরা বাংলা বার মাসের হিসেব করতো বা বার মাস পালন করতো অনেক অনেক কাল আগে থেকেই। কিন্তু তা ছিল সৌর পঞ্জিকা অনুসারে। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। গ্রেগরীয় হল ইংরেজি পঞ্জিকা বা পাশ্চাত্য দেশের পঞ্জিকা।যার প্রথম মাস জানুয়ারি। সৌর পঞ্জিকার হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম ,পশ্চিমবঙ্গ , কেরালা ,মনিপুর , নেপাল , উড়িষ্যা , পাঞ্জাব,
তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। তবে তখন এটি এতো জাকঁজমক ভাবে পালিত হতো না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ছিল একটি ঋতু ভিত্তিক উৎসব।যার মূল তাৎপর্য ছিল “কৃষিকাজ”। কারণ তখন কৃষকরা ছিল সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর।।

মোগল সাম্রাজ্যর সময়ে হিজরি পঞ্জিকা মতে সকল ধরনের খাজনা আদায়ের কাজ করা হত। কিন্তু হিজরী পঞ্জিকা ছিল চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই হিজরী মাসের সাথে বাংলায় ফসল উৎপাদন বা খাজনা আদায় কোন ভাবেই মিলত না। প্রতি বারই খাজনার হিসেব গড়মিল হয়ে যেত। কারণ বাঙ্গলার ঋতু গুলোর সাথে হিজরী মাসের কোনরকম ই মিল হতো না।

তখন বাংলার সিংহাসনে ছিলেন মুগল সম্রাট জালাল উদ্দিন মুহান্মদ আকবর। তিনি সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে পঞ্জিকায় সংস্কার আনার নির্দেশ দেন।

তার জন্য সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় যখন সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহণ করেন, ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন , পরে ” বঙ্গাব্দ ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে। (উইকিপিডিয়া :বঙ্গাব্দ এবং পহেলা বৈশাখ)

সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকেই এই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কথা জানা যায়। তারঁ শাসনামলেই — সকল ধরনের খাজনা চৈত্র মাসের শেষ দিন সম্পূর্ণভাবে পরিশোধ করা হতো। তারপর প্রত্যেক অঞ্চলের ভূমির জমিদারগণ তাদের অধিবাসীদের মিষ্টি মুখ করাতেন। ছিল হালখাতার প্রচলন ও। আরো বিভিন্ন রকম সামাজিক অনুষ্ঠান ও এদিন পালন করা হতো।(উইকিপিডিয়া)

তবে এইযে বর্ষপঞ্জি এটাকে সংস্কার করা হয়। যখন দেশ বিভক্তি ঘটে, তখন বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ মানুষের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে তুলে ধরেন।

আর তারঁ নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক বাংলা সনের পরিবর্তন আনা হয়। আর তার জন্য ১৪ই এপ্রিল প্রতি বছর আমাদের বাঙ্গলিদের বাংলা নববর্ষ।

তবে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, সহ আরো বিভিন্ন প্রদেশ ও কিন্তু বাংলা ভাষা-ভাষীর মানুষ রয়েছে। তার আবার ড.মুহান্মদ শহীদুল্লাহ’র সংস্কার করা এই বাঙ্গলা পঞ্জিকা কে মেনে নেয়নি। তারা সম্রাট আকবরের প্রণীত সেই বাংলা সনকেই মেনে চলেছেন।

ওবাবা! এতক্ষণ তো ইতিহাস লিখছিলাম।আর ইতিহাস তো শেষ হয় না। কত কথা থাকে।আর তাতেই তো ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল, পহেলা বৈশাখের আনন্দ আর উৎসবের গল্প, ঘটনা গুলি।।

আমাদের এই প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখে অনেক আয়োজন থাকে। হালখাতা, বৈশাখী মেলা, বাউল গান, নৌকা বাইচ, সাংস্কৃতিক আয়োজন তো থাকেই।

আর আমাদের পহেলা বৈশাখের মূল আকর্ষণ থাকে “মঙ্গল শোভাযাত্রা”। গত ৩০শে নভেম্বর ২০১৬সালে UNESCO এই উৎসব কে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দিয়েছিলো।

এবার একটু বাঙ্গালির এই উৎসবগুলো নিয়েই একটু বলি।

মঙ্গল শোভাযাত্রা : বাংলাদেশের মানুষের লোক ঐতিহ্যের প্রতীক এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।।

এটির মাধ্যমে সমস্ত রকম অশুভ শক্তির যেন বিনাশ বা পরাজয় ঘটে, মঙ্গল বা মানব জীবনের ভালো দিক গুলোর বার্তা ছড়িয়ে দিতেই এই শোভাযাত্রা। এটি একটি অসম্প্রদায়িক উৎসব, যেখানে জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করে থাকেন। বলা চলে, সকল মানুষ কে এক করবার একটি প্রতীক এই উৎসব।

পহেলা বৈশাখের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীরা এতে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। এতে থাকে মুখোশ, মাটির হাড়ি কিংবা শখের হাড়ি, ছেলেদের কেউ কেউ সাজে কৃষক। যেহেতু এটা কৃষক দের উৎসব তাই। তারপর বেতের হাড়ি থাকে, লক্ষীপেচাঁ ছাড়া এই মঙ্গল শোভাযাত্রা হতেই পারে না। তাই অবশ্যই এটি থাকবে। আবার থাকে রুপকথার সেই সুক পাখি ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখেই সাজানো হয় পহেলা বৈশাখের এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।

তবে এখন এটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই হয় না বরং বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের

চারুকলা অনুষদ থেকে ই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

১৯৮৫সালে চারুপীঠ নামের যশোরের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রথম এই শোভাযাত্রার আয়োজন করে।

পরবর্তীতে ১৯৯৫সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক প্রতি বৎসর এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

হালখাতা: আমি আগেই বলেছি এই হালখাতা উৎসব কিন্তু মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পালিত হয়ে আসছে।।

তো এদিন পুরনো সব হিসাব শেষ করে ব্যবসায়ীরা নতুন হিসাবের খাতা খোলেন। আর বছরের প্রথমদিন যে ব্যবসায়ীরা পুরনো সব হিসেব নিকেশ শেষ করে নতুন হিসাবের খাতা খোলেন একেই বলা হয় “ হালখাতা”।এজন্য বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

এসময় আগত ক্রেতাদের মিষ্টি মুখ করানো হয়ে থাকে।

বটতলার মেলা বা বউ মেলা:

এ এক অন্য রকম উৎসব। অনেকেই নাম শুনেই হয়ত বলছেন, বউমেলা!

তা আবার কি।

এখানে কি বউ পাওয়া যায়?

বট তলার বউ মেলা

না প্রিয় পাঠক তা একে বারেই নয়।

পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে– ঈশা খাঁর সোনারগাঁওয়ে প্রাচীনকাল থেকেই এক মেলা বসে যার নাম বউমেলা। কেউ বা আবার এটিকে “বটতলার মেলা” বলে থাকেন। এখানকার স্থানীয় মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর আগে কোন এক পহেলা বৈশাখে শুরু হয়এই মেলা। মেলাটি পাঁচ দিনব্যাপী চলে। একটি প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন দেবী সিদ্ধেশ্বরী এখানে অধিষ্ঠিতা। আর তারঁ পুজোর জন্য ই তাদের এখানে সমবেত হওয়া। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের কুমারী মেয়েরা, নববধূ রা, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই় স্থামে আসেন, এসে পূজা-অর্চনা করেন। বিভিন্ন নৈবদ্য সহযোগে এখানে দেবীর উদ্দেশ্যে পুজো দেন তারা। আবার কেউ কেউ পাঁঠাবলি ও দিয়ে থাকেন। আর এই পুজো কে ঘিরে এই স্থানে বসে বিরাট মেলা।

আদিবাসীদের বর্ষবরণ:

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বর্ষবরণ উৎসব দেখার মতো। কেননা এই দিন তারা নতুন পোষাক পরে, তারপর তারা তাদের স্ব স্ব সৃষ্টকর্তার নিক্ট আরাধনা আর তারপর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান নাচ আর আনন্দে মাতে

তাদের সব থেকে উল্লেখ্যযোগ্য উৎসব হচ্ছে– জলকেলি বা পানি উৎসব যেটাকে বলা হয়।

তাদের এ উৎসব কে বলা হয় “বৈসাবি উৎসব”।

বৈসাবি উৎসব

তবে আদিবাসীদের আরো একটি উৎসব আছে আর তা হল, বিহু উৎসব।

তিন রকমের বিহু আছে, বহাগ বিহু, কাতি বিহু, এবং সবশেষ মাঘ বিহু। বৈশাখের প্রথমদিন থেকেই শুরু হয়ে এ উৎসব চলে পরবর্তী ছয় মাস। এটি মূলত: ওপার বাংলার আসামের আদিবাসীদের উৎসব। তবে এপার বাংলার আদিবাসীরাও এটি পালন করে থাকেন।

বৈশাখী মেলা:

বৈশাখে যদি কোথাও বৈশাখি মেলা না বসে তাহলে তা পহেলা বৈশাখ কেউ বলতেই পারবে না। কারণ, পহেলা বৈশাখে বৈশাখী মেলা বসতেই হবে। আর এ মেলায় নাগরদোলা, বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, মাটির তৈজস্পত্র, কাঠের পুতুল,আর খাওয়া দাওয়া তো থাকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ছায়ানটের আয়োজনে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান দারুণ উপভোগ্য। বুলবুল ললিত কলা একাডেমী সহ সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে চলে বৈশাখ কে বরণ করবার আনন্দ আয়োজন।

আর চট্টগ্রামের সি আর বি শিরিষতলাতে বৈশাখের সাংস্কৃতিক আয়োজন চোখে পড়ার মতো। চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা তো ঐতিহ্যগত এবং বিখ্যাত ও প্রাচীন একটি নববর্ষের আয়োজন। এছাড়াও বাংলাদেশের সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান দিন টি উপলক্ষে নানান ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। তবে যেটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার তা হচ্ছে, নাড়ু, খই, মুড়ি।কারণ, যেহেতু পহেলা বৈশাখ কৃষি ভিত্তিক উৎসব, তাই এদিন নতুন চালের তৈরি এ খাবার গুলো অনেকেই খেয়ে থাকেন।

আর এবার আসি একটু পান্থা ইলিশ এর কথায়। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এখন শহুরে সংস্কৃতিতে একটা ভাব এসেছে আর তা হল পান্থা ইলিশের। এটা কিন্তু এই আবহমান বাঙ্গলার কোন ঐতিহ্যগত উৎসব নয়। এটা আমাদের শহুরে সংস্কৃতির হাত ধরে ওঠা। ব্যস, আর কিছু ই নয়। বলা চলে, নতুন প্রজন্মের ই তৈরি করা এটি একটি বানোয়াট সংস্কৃতি।

চিন্তাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার এক লেখায় বলেন,

“গরিব মানুষের খাবার পান্তাভাত। রাতে খাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত রাখার কোনও উপায় ছিল না; তাই পানি দিয়ে রাখা হতো এবং সকালে আলুভর্তা, পোড়া শুকনো মরিচ ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হতো। আমিও ছোটবেলায় খেয়েছি। কিন্তু এখন পান্তা-ইলিশ ধনী লোকের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে এবং এটা দুর্মূল্যও বটে যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে।”

বৈশাখের সাজে যদি দেখি যেহেতু এটা আবহমান বাঙ্গালির উৎসব কৃষিভিত্তিক উৎসব তাই অনেকেই এইদিন বাঙ্গালি ঐতিহ্য হিসেবে ছেলেরা লুঙ্গি, সাথে গেঞ্জি, কেউ বা মাথায় গামছা ও পড়েন। আর পড়েন লাল পারের মেয়েরা শাড়ি।তবে ছেলেদের বেশির ভাগ ই পড়ে পাঞ্জাবি।সমস্ত পুরাতন, জীর্ণ তাকে বাদ দিয়ে নতুন কে বরণ কে নেওয়ায় এই দিনের বৈশিষ্ট্য।

আর পহেলা বৈশাখ নিয়ে এখনো মানুষের মধ্যে কিছু কুসংস্কার লক্ষ্যনীয়।

অনেকে মনে করেন এটা কোন একটা নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের উৎসব। না প্রিয় পাঠগণ এটা নির্দিষ্ট কোন ধর্মের মানুষের উৎসব নয় এটা সকল বাঙ্গালিদের প্রাণের উৎসব।।বরং বলতে পারি, এটা মূলত: কৃষকদের উৎসব।এদেশের কৃষক রাই এই উৎসব পালন করত সেই আবহমান কাল থেকে।

আবার, অনেকে ই মনে করেন মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে হিন্দু ধর্মের মিল আছে বা এটা হিন্দুদের ধর্মীয়। না একদম ই না প্রিয় পাঠকগণ। এই মঙ্গলশোভা যাত্রার সাথে কোন ধর্মের মানুষের ই কোন প্রকার মিল নেই। কেনো থাকবে, এটা তো কোন ধর্মীয় উৎসব নয়। এটা আমাদের আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ঐতিহ্য এর বাহক ধারক। বরং, এর মর্মাথ হচ্ছে, যেকোনরকম অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যেন আমরা লড়াই করতে পারি। সত্য ও ন্যায় কে সমর্থন জানাতে পারি তার ই নিদর্শন। এছাড়া আর কিছুই নয়।

‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতিসত্বার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বছরের প্রথম দিনে ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’’ মাধ্যমে অপশক্তির অবসান এবং বাংলাদেশের মানুষ কল্যাণময় ভবিষ্যতের আশা ব্যক্ত করে চলেছে। (উইকিপিডিয়া :মঙ্গল শোভাযাত্রা)

মূলত: এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে শান্তি, সত্য আর ন্যায়ের কথাগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর পান্তা ইলিশের সাথে হিন্দুদের কোন সম্পর্কই নেই। বা নেই নিদিষ্ট কোন ধর্মের মানুষের। কেননা, হিন্দুরা কিন্তু অনেকেই নিরামিষাশী। এইদিন অনেকেই নিরামিষ খান। মাছ, মাংস ও খান। কিন্তু এই ইলিশের ব্যাপারটা কৃষকরা ও চালু করেনি।এটা এদেশীয় শহুরে সংস্কৃতির নতুন আবহ। আর নতুন বছর মানেই হচ্ছে — পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুন কে বরণ করা। তাই সকলে নিজেদের ঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সাজান, গুছান। আর নিজেরা নতুন জামা কাপড় পরধান করেন।

পরিশেষে, কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছিলেন,

“এমন দেশ টি কোথাও খুজে পাবে নাক তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”।

সত্যি তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। যেখানে রয়েছে বার মাস। এই বারটি মাস কিংবা ছয়টি ঋতু তে প্রকৃতি তারঁ নানা রঙ্গের পসরা সাজিয়ে বসে।আর প্রকৃতির এই নানা রুপের কারণে আমাদের এই বাঙ্গলায় বার মাসে তেরো পার্বণ।

পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ হচ্ছে তেমন ই একটি। আবহমান বাংলার এই উৎসব সকল বাঙ্গলির প্রাণের উৎসব।

তাইতো কবিগুরু বৈশাখ কে আহবান জানিয়েছেন–

“এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি,

যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।”

তাই আমরাও আমাদের বাঙ্গলার এই আবহমান উৎসব পহেলা বৈশাখ কে আহবান জানাই। ভুলে যায়, সব রকম দু:খ কষ্ট। সব পুরাতন জীর্ণ কে ফেলে নতুনের আহবানে সাড়া দেয়।

সব রকম কুসংস্কার ভুলে যাই। আর অসম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে আবহমান বাংলার, বাঙ্গালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ কে বরণ করে নিই।আর সকলে মিলে মাতি প্রাণের উৎসব কে বরণের উল্লাসে।

আবারো সবাইকে জানাই পহেলা বৈশাখের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

শুভ নববর্ষ।।

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img