হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্সের ২০২৫ সালের তালিকায় বাংলাদেশের পাসপোর্ট তিন ধাপ এগিয়ে ৯৪তম অবস্থানে উঠে এসেছে। এক বছর আগে যেখানে অবস্থান ছিল ৯৭তম, সেখানে এই উন্নয়ন নিঃসন্দেহে পরিসংখ্যানগতভাবে ইতিবাচক। কিন্তু বাস্তবতায় বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণে ভিসা জটিলতা, প্রত্যাখ্যান ও হয়রানির মাত্রা দিনদিনই বেড়ে চলেছে।
এই সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা বর্তমানে ৩৯টি দেশে ভিসা ছাড়া প্রবেশাধিকার পান। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, বাহামা, বলিভিয়া, ফিজি, কেনিয়া, সামোয়া, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, কুক আইল্যান্ডস, টুভালু, ডোমিনিকা, রুয়ান্ডা, সেশেলসসহ আরও কিছু নাম।
তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই ৩৯টি দেশের মধ্যে অধিকাংশেই বাংলাদেশি পর্যটকদের যাতায়াত নেই বললেই চলে। এর বিপরীতে, মালয়েশিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, জার্মানি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে বাংলাদেশিদের ভ্রমণ ও অভিবাসনের আগ্রহ বরাবরই বেশি। অথচ এসব গন্তব্যে ভিসা পাওয়া এখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।
মালয়েশিয়ায় জটিলতা
সম্প্রতি মালয়েশিয়া ৩০০’র বেশি বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীকে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠিয়েছে। এসব যাত্রীর বৈধ ভিসা থাকলেও ‘নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা’ ও ‘কাগজপত্রে অসঙ্গতি’কে কারণ দেখিয়ে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে অবৈধ কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের নাগরিকদের জড়িত থাকার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে ভিসা পাওয়া আরও কঠিন হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতের সীমাবদ্ধতা
গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারত কড়া অবস্থানে যায়। গুরুতর অসুস্থ রোগী ছাড়া অন্যান্য ভিসা কার্যক্রমে কঠোরতা আরোপ করা হয়। এ কড়াকড়ি এখনো পুরোপুরি প্রত্যাহার হয়নি।
আরব আমিরাতের অনির্দিষ্টতা
৮ মার্চ থেকে ভিসা চালু করলেও আমিরাত গত ১০ মে থেকে আবারও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। দেশটিতে অবস্থানকারী বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকের সংখ্যা মাত্র ৮ শতাংশ হলেও, নিয়ম লঙ্ঘনের হার ২৫ শতাংশের বেশি বলে দেশটির অভিযোগ।
যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে প্রত্যাখ্যান
২০২৪ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশিদের ৫৪.৯০ শতাংশ ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। একই চিত্র শেঞ্জেন অঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে। ভ্রমণ, শিক্ষা ও ব্যবসায়িক ভিসার ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান ও দীর্ঘসূত্রতা স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে।
জার্মানিতে শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকারের তারিখ পেতেই লেগে যাচ্ছে দেড় থেকে দুই বছর। যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা পেতে এখন নিরাপত্তা যাচাই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তদারকি, এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সময় ও জট
থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো জনপ্রিয় দেশগুলোর ক্ষেত্রেও ভিসা প্রক্রিয়া দীর্ঘতর হয়েছে। থাইল্যান্ডে আবেদন করতে হচ্ছে কমপক্ষে ৪৫ দিন আগে। ব্যাংকক, পাতায়া, ফুকেটে পর্যটকদের আগ্রহ থাকলেও অনেকে ভিসা পান না। যারা পান, তাদের অপেক্ষায় সময় লাগে এক থেকে দুই মাস।
দূতাবাসগুলোতে কড়াকড়ি
ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাস বর্তমানে কাগজপত্র যাচাইয়ে কঠোরতা অবলম্বন করছে। সরকারি আমন্ত্রণপত্র বা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আবেদনও নাকচ হচ্ছে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে— তথ্য গোপন, জালিয়াতি, সাক্ষাৎকারে অনুপযুক্ততা ও আগের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা।
দালালচক্রের দৌরাত্ম্য
ভিসা জটিলতার সুযোগ নিচ্ছে দালালচক্র। তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করছে। অনেক আবেদনকারী তাদের ফাঁদে পা দিয়ে জাল কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন, যার ফলে পুরো পাসপোর্টধারী গোষ্ঠীই সন্দেহের চোখে পড়ছে।
কেন নাকচ হয় ভিসা আবেদন
ভিসা প্রত্যাখ্যানের পেছনে সাধারণ কারণগুলো হলো:
জাল কাগজপত্র জমা দেওয়া
ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য প্রদান
সাক্ষাৎকারে অযোগ্যতা
ইংরেজি দক্ষতার অভাব
পূর্ববর্তী দেশত্যাগ না করা
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার সন্দেহ
আর্থিক অস্থিরতা বা আয়ের অস্বচ্ছ উৎস
দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম দেখানো
উপসংহার
হেনলি ইনডেক্সে পাসপোর্টের অবস্থান উন্নত হলেও বাস্তব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের আন্তর্জাতিক যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা বেড়েছে। প্রয়োজন এখন কেবল র্যাংকিং-ভিত্তিক গৌরব নয়, বরং পাসপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগ, অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধ, ভ্রমণ নীতিমালায় স্বচ্ছতা এবং নাগরিকদের সচেতনতা।