– জুবায়ের ইবনে কামাল
প্রথমে একটা গল্প বলা যাক। এক রাজা তার রাজ্যের মুখে একটি ছবি ঝুলিয়ে দিলেন। আর বললেন, যে যেখানে ছবিটির ভুল পাবে সেখানেই একটি দাগ দেবে। দু’দিন যেতে না যেতেই পুরো ছবিতে দাগাদাগির কালিতে মুল ছবিটিই মুছে গেলো। এবার রাজা একইরকম আরেকটি ছবি ঝুলিয়ে বললেন, এখানে যার যেই অংশ সুন্দর লাগবে সেখানে দাগ দেবে। মাসের পর মাস গেলো কিন্তু সেই ছবিতে একটি দাগও লাগলোনা।
বাংলা সিনেমা আমি নিজেও দেখতে পছন্দ করিনা। কারণ কাহিনী সব আমার জানা। হিরোইনের বাবা বড়লোক হবে, নায়ক থাকবে দরিদ্র। শেষে মারামারির পর হিরোইনের বাবা ধরা গলায় বলবেন, তোদের ভালোবাসার কাছে হেরে গেলাম!
একটা সময় ছিলো হাজার হাজার মানুষ বাংলা সিনেমা দেখা ছেড়ে দেয়া শুরু করলেন। শুধুমাত্র এই সেকেলে আর গতানুগতিক সিনেমার কারণে। তখন কজন পরিচালক অসাধারণ কিছু কাজ নিয়ে আসলেন। দর্শকরা বাংলা সিনেমার প্রতি ফিরতে বাধ্য হলেন।
আমরা হুজুগে বাঙালীই বটে। লোকের কথায় নিজের কান আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। নিজে কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা আমরা করিনা। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সিনেমা “ডুব” বের হবার পর থেকেই এই ঘটনাটা বার বার ঘটছে। নেগেটিভ রিভিউতে ছড়াছড়ি। মজার বিষয় হলো, এর বেশীরভাগ মানুষই ছবিটি দেখেননি। অথবা তারা “তোমার-আমার ভালোবাসা” টাইপ মুভি ছাড়া কিছু পছন্দ করেন না। কেননা তাদের প্রথম জিজ্ঞাসাই থাকে “নায়িকা কে?” দু:খিত ডুব সিনেমায় কোন নায়িকা নেই।
একজন পরিচালক সবসময় আড়ালে থাকেন। তার সামর্থ্যের শেষ টুকু দিয়ে তিনি অভিনেতাদের কাছ থেকে কাজটি করিয়ে একটু কবিতা বানান। যেই কবিতা পড়ে আমরা সেই অভিনেতাদের বাহবা দেই। পরিচালক কে তার খোঁজ নেবার প্রয়োজন হয়না। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী সেদিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার ছবিকে কেউ ‘তিশার ছবি’ বা ‘ইরফান খানের ছবি’ বলেনা। সবাই বলে এটা ফারুকীর ছবি। বর্তমানে খুব কম পরিচালই আছে, যাদের সিনেমায় অভিনেতাদের নাম না নিয়ে পরিচালকের নাম নিয়ে বলা হয় ‘এটা ফারুকীর ছবি’।
এবার একটু সিনেমাটোগ্রাফি দেখি। একটা সাধারণ চিত্রকে কিভাবে অসাধারণ চিত্রে রূপান্তরিত করা যায় তার মধ্যেই পরিচালকের সার্থকতা নিহিত। বাবা নতুন বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। তার সাথে কোন সম্পর্ক নেই এখন। এমতাবস্থায় সেই বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেলো। দৃশ্যটা কিরকম দাঁড়াবে? গতানুগতিক সিনেমায় হয়তো কেঁদে বুক ভাসিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি হবে। কিন্তু বাস্তবে আদৌ কি তা হয়? ‘ডুব’ সিনেমায় এরকম ঘটনায় দেখা গেলো সাবেরী তার মাকে বলছে, ‘মা প্রতিদিন ডিম পোচ খেতে ভালো লাগেনা। কাল থেকে পেয়াজ-মরিচ দিয়ে ভেজে দিও।’ ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে অচেনা এক ভদ্রলোক সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। অথচ সম্পূর্ণ কথাটাই হচ্ছে ফ্রেমের বাইরে। তারা বাইরে থেকেও ভেতরে।
চারকোণা ফ্রেমের ঘটনা যখন ফ্রেমের বাইরে এসে হৃদয় ছুঁয়ে যায় তখন আপনি কি বলবেন! আমি ব্লকব্লাস্টার বা সিনেপ্লেক্সে গিয়ে ছবি দেখিনা। আমি নিন্মবিত্তদের আনাগোনা যেখানে সেখানে ছবি দেখি। রাজধানীর মধুমিতা সিনেমা হলে ডুব দেখে বের হচ্ছি। দেখলাম এক বৃদ্ধ চাচা চোখ মুছতে মুছতে যাচ্ছে। আমি বললাম, চাচা কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, জাভেদ যখন তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো বাবা! কেমন আছো, মনে হইলো আমার ছেলেটা আমারে বলতেছে। একসময় আমারেও এই কথাটা বলছিলো আমার ছেলে। মনে হইলো সেই কাহিনী আবার চোখের সামনে ঘটলো।
হলে আরো দেখলাম বেশ কিছু নিন্মবিত্ত পরিবারের সবাই মিলে এসেছে। ছোট ছোট মেয়েরা চুল আচড়ে লিপস্টিক দিয়ে সেজে এসেছে। আমি একজন কে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি? তিনি নিচু সরে বললেন, বাবা! সব ছবি পরিবারের সাথে দেখা যায়না। পোলাপান মানুষ। একটা ছবিই পাইলাম সবারে নিয়া দেখা যাইবো। তাই সবাইরে নিয়ে আসলাম। দেখেন পোলাপানগুলা কত খুশী।
একটা সিনেমা। তাকে ঘিরে কতগুলো গল্প ঘটছে নিয়মিত। পরিচালকের কানে সবগুলো গল্প হয়তো পৌঁছায় না। কিন্তু তিনি এরকম আশা করেই কাজ করেন। ‘ডুব’ যে অদ্ভুত সুন্দর একটা ছবি, আর এটা মানুষকে কতটা অভিভূত করেছে তা দেখার জন্য ছোট ছোট হলের বাইরে ঘোরাফেরা করুন। উত্তর পেয়ে যাবেন।
মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী নিজে গল্পকার নন। তবে তিনি গল্প দেখান। সিনেমাওয়ালা এই ভদ্রলোকের সাথে আমার কখনো পরিচয় হয়নি কিন্তু বিস্ময়ের সাথে তার কাজ দেখি। জাজ মাল্টিমিডিয়াকেও ধন্যবাদ সিনেনার এরকম অগ্রযাত্রায় সাথে থাকার জন্য। এই সিনেমা কার বায়োপিক, কেমন রিভিউ মানুষ দিচ্ছে তা একপাশে ফেলে একবার ডুব দিন। অবশ্যই আপনি ডুবের আনন্দ উপলব্ধি করতে পারবেন।