ইশতিয়াক আহমেদ
ভোলা জেলার অধীনস্থ মনপুরা দ্বীপ বিগত কয়েক বছর ধরে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মনপুরা দ্বীপটিকে নিয়ে বাংলাদেশে ‘মনপুরা’ নামের চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ার পর থেকে এই দ্বীপটির জনপ্রিয়তা আরো বাড়তে থাকে। বর্তমানে মনপুরা দ্বীপ দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকদের কাছেও অনেক জনপ্রিয়। দ্বীপ জেলা ভোলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট্ট এক দ্বীপ মনপুরা। ভোলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা আটশ বছরের পুরানো এ দ্বীপটি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পদের বৈচিত্র্যে ভরপুর এ দ্বীপে না আসলে বোঝাই যাবে না এ দ্বীপ উপজেলায় কি মায়া লুকিয়ে আছে। পর্যটক বা ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে মুগ্ধতার বন্ধনে আটকে দেয়ার বহু জাদু ছড়ানো আছে এ দ্বীপে। এখানে ভোরের সূর্য ধীরে ধীরে পৃথিবীতে তার আগমনী বার্তা ঘোষণা করে আবার বিকালের শেষে এক পা-দুপা করে আকাশের সিঁড়ি বেয়ে লাল আভা ছড়াতে ছড়াতে পশ্চিমাকাশে মুখ লুকোয়। রাতে নতুন শাড়িতে ঘোমটা জড়ানো বধুর মত সলাজ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় পুরো দ্বীপ। এই মনপুরা দ্বীপের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। সাতশ বছর আগে পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল মনপুরায়। তাই আজও এখানে পর্তুগিজদের নিয়ে আসা কেশওয়ালা লোমশ কুকুর দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া মনপুরায় আরও দেখা মিলবে হরিণের পালের। কারণ এখানে রয়েছে হরিণের অভয়াশ্রম। জোয়ারের সময় হরিণগুলো প্রধান সড়কের কাছে চলে আসে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে,হরিণের পাল যখন রাস্তা পার হয় তখন যানবাহন চলাচল কিছুসময়ের জন্য বন্ধ রেখে অপেক্ষা করতে হয়। মনপুরার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে হাজার হাজ
ার একরের ম্যানগ্রোভ বন। যেখানে জীবিত গাছের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস মনপুরাকে সাজিয়েছে সবুজের সমারোহে। মনপুরার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল চর তাজাম্মুল, চরজামশেদ, চরপাতিলা, চর পিয়াল, চরনিজাম, লালচর, বালুয়ারচর, চর গোয়ালিয়া, সাকুচিয়াসহ ছোট-বড় ১০-১২টি চরে বন বিভাগের প্রচেষ্টায় চলছে নীরব সবুজ বিপ্লব। চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়েই যেন এসব চরের জন্ম। চরগুলো কিশোরীর গলার মুক্তোর মালার মতো মনপুরাকে ঘিরে আছে। শীত মৌসুমে হাজার হাজার অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে সমগ্র চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের অতিথি পাখির উড়ে বেড়ানো, হরিনের পালের ছোটাছুটি, সুবিশাল নদীর বুক চিরে ছুটে চলা জেলে নৌকা, ঘুরে বেড়নো মহিষের পাল আর আকাশ ছোঁয়া কেওড়া বাগান কঠিন হৃদয়ের মানুষের মনও ছুঁয়ে যায়। চারদিকে নদীবেষ্টিত মনপুরায় নৌকা কিংবা সাম্পানের ছপছপ দাঁড় টানার শব্দ আর দেশি-বিদেশি জাহাজের হুঁইসেলের মিলে মিশে একাকার হলে মনে হয় কোনো দক্ষ সানাইবাদক আর তবলচির মন ভোলানো যুদ্ধ চলছে। মনপুরায় যে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যই দেখা যাবে তা নয়। গতানুগতিক সব খাবার ছাড়াও তিনটি স্পেশাল আইটেম আছে মনপুরার। এগুলো হচ্ছে খাসি পাঙ্গাস, মহিষের দুধের কাঁচা দই ও শীতের হাঁস। নদী থেকে ধরে আনা টাটকা খাসি পাঙ্গাস আর চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো মহিষের পাল থেকে সংগৃহীত কাঁচা দুধ বা দইয়ের স্বাদই আলাদা। তাছাড়া মেঘনার টাটকা ইলিশের স্বাদও ভোলা যায় না কখনো। মনপুরা দ্বীপে থাকা নিয়ে নেই কোনো চিন্তার কারণ। থাকার জন্য মনপুরা দ্বীপে ৩টি ডাকবাংলো (সরকারি ডাকবাংলো,প্রেসক্লাব বাংলো,কারিতাস বাংলো) আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সরকারি ডাকবাংলোয় স্বল্প মূল্যে থাকা যায়। এছাড়া মনপুরা দ্বীপের যেকোনো জায়গায়
ক্যাম্পিং করা যাবে। ক্যাম্পিং এর জন্য আদর্শ একটি জায়গা মনপুরা। ঢাকা থেকে সরাসরি লঞ্চে মনপুরায় যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে হাতিয়াগামী লঞ্চ (এমভি ফারহান-৩,এমভি ফারহান-৪,টিপু-৫) মনপুরার রামনেওয়াজ ঘাটে প্রায় এক ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করে। মনপুরার মানুষও ঐ লঞ্চেই ঢাকায় যাতায়াত করেন। আবার ঢাকা থেকে ফেরেন ঐ একই লঞ্চে। এছাড়া ভোলা হয়ে তজুমদ্দিন ঘাটের সি-ট্রাকে মনপুরায় যাওয়া যায়। সি-ট্রাকটি তজুমদ্দিন থেকে ছাড়ে প্রতিদিন বিকাল ৩টায় আর মনপুরা থেকে ছাড়ে সকাল ১০টায়। সাইক্লিং করার জন্য মনপুরা দ্বীপ একটি ভালো অপশন। কখনো সবুজ রাজ্য আবার কখনো উত্তাল মেঘনা নদীকে রাস্তার পাশে রেখে দ্বীপে সাইক্লিং করার ব্যাপারটা বেশ আনন্দদায়ক। মনপুরা একজন ভ্রমণপিপাসুকে খুব সহজেই সৌন্দর্যের বাঁধনে বাঁধতে পারে। আর এজন্যই হয়তো একে মায়াবী দ্বীপ বলা হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করলে মনপুরা হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন স্পট। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনা সময়ের ব্যাপার মাত্র।