আমাদের জাগো সুন্দর অনুষ্ঠান
বোধনের শিক্ষার্থী হিসেবে এনিয়ে আমাদের অনুভূতিগুলো এবং এক থলে জমানো স্মৃতি”
——– আর তার উপরেই লেখা আমার এই প্রবন্ধটি।। গত ৫ই জুলাই বোধন কিন্তু সত্যিই আমাদের রাজা ই হয়েছিল।।
কিভাবে আর কেনো? তার কারণ খুজতেঁ হলে প্রিয় পাঠক আপনাদের যে কষ্ট করে পুরো প্রবন্ধটি একবারটি পড়ে যেতে হবে।।
আবৃত্তি শিখবো, আবৃত্তি শিখবো এবং আবৃত্তি শিখবো — এরকম একটা মনোভাব নিয়ে আমার বোধন আবৃত্তি স্কুলে শিক্ষার্থী হিসেবে বোধনের অনন্য ৫১ আবর্তনে অংশ নেওয়া। সেই থেকে এখনো অব্দি আমি বোধনের শিক্ষার্থী।
এইতো সেদিন ফেব্রুয়ারিতে, আমরা এই অনন্য ৫১ আবর্তনের শিক্ষার্থীরা নবীনবরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক পা দু পা করে বোধন পরিবারের যে বিশাল ভালোবাসার ভান্ডার আছে, তাঁদের যে প্রশিক্ষণের বাইরেও শিক্ষার্থীদের প্রতি স্নেহ মায়া মমতায় আবদ্ধ একটা জগত আছে, আছে আলাদা একটা পরিবার তাঁর একটা ক্ষুদ্র অংশ হতে চেয়েছিলাম। অনেকটা সময় আমরা এই অনন্য ৫১ আবর্তনের শিক্ষার্থীরা পার করে এসেছি।
জুলাই মাস চলছে। কড়াই গন্ডায় হিসেব না কষলেও এমনিতেই যদি হাতের কড়ের হিসেব কষি তবু বলতে হয় আমরা আমাদের সমাবর্তনের একেবারেই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে । এ জানি হাত বাড়ালেই সমাবর্তন।
তাই বলছি, কতটুকু বোধনের কাছাকাছি আসতে পেরেছি কিংবা আমাদের বোধন যা শিখিয়েছে—
“নিজেদের মধ্যে অর্থাৎ আমরা যারা বোধনের শিক্ষার্থী আছি তাঁদের মধ্যে বোধের বা চেতনার বিকাশ ঘটানো।” সত্যিই জানিনা সেই শিক্ষাটাকে কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি এখনো অব্দি । তবে ভালোবাসার বোধন থেকে পাওয়া এই শিক্ষা ধারণের প্রয়াস ছিলো এবং ভবিষ্যতেও থাকবে অবিরামভাবে।
সেই বোধের জায়গাটুকুতে আমাদের আরো বিকশিত করা কিংবা এইযে এতদূর অব্দি আমরা শিখতে গিয়ে এসেছি তা কতটুকু গুছানো ছিলো বা কতটা নিতে পেরেছি তারই প্রেক্ষিতে গত ৫ই জুলাই, চট্টগ্রামের থিয়েটার ইন্সটিটিউটে বোধন আবৃত্তি স্কুলের আমাদের অনন্য ৫১ আবর্তনের জাগো সুন্দর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আমি জাগো সুন্দর কি এ প্রসঙ্গে যদি আরেকটু গুছিয়ে বলি তবে বলতে হয়—-
শিক্ষার্থীদের মানে আমাদের মঞ্চে অভ্যস্থ করে তোলার প্রয়াসই হচ্ছে এই‘জাগো সুন্দর’।
দেশবরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী এবং আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন সোহেল আনোয়ার স্যার একবার আমাদের ক্লাস নিতে এসেছিলেন। তখন স্যার আমাদের এই জাগো সুন্দর অনুষ্ঠান নিয়ে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন। অবশ্য এর আগে যে জাগো সুন্দর নিয়ে একেবারেই শুনিনি তা না। আমাদের সকলেরই আরেকজন শ্রদ্ধাভাজন মানুষ বোধনের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আমাদের দাদা সঞ্জয় দাদার মুখেই এনিয়ে বহুবার শুনেছি।
কিন্তু, জাগো সুন্দর কেন্দ্রিক আমাদের কাজটা শুরু হয়েছিল শ্রদ্ধেয় সোহেল আনোয়ার স্যার যখন বললেন, “তোমরাই এ অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ আয়োজন করবে, তোমরাই অইদিনের জন্য হবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক আবার তোমরাই আবৃত্তি করে তোমরাই অইদিনের শিল্পী হবে”।।
স্যারের মুখে একথা শুনে অইদিন শুধু লাফ দিয়ে বলতে পারিনি —- ইয়ে…. কি মজা!
কারণ, আমরা অইদিন একদিনের জন্য আয়োজক হবো, আবার আমরাই শিল্পীর ভূমিকায় থাকবো, আবৃত্তি করবো, কতটা যে মজার ব্যাপার এটা তা বলার বাইরে!
এ জানি রবীন্দ্রনাথের “আমরা সবাই রাজা” গানের মতো।
“আমরা সবাই রাজা
আমাদের এই রাজার রাজত্বে—
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা যা খুশি তাই করি,
তবু তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাধাঁ নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে—
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কি স্বত্বে?”
সোহেল স্যারের মুখে জাগো সুন্দরের কথা শুনে আমার জানি তাই ই মনে হয়েছিল। আমরাই একদিনের জন্য রাজা হবো, আবার আমরাই মন্ত্রী, আমরাই আবার প্রজা, আমরাই সান্ত্রী।
তবে এসবের বাইরে আমরা সবাই রাজা হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের কিন্তু এক জনই রাজা থাকবে। সে আমাদের সবার মধ্যমনি। তবে অইদিনের জন্য আমাদের সবার রাজা কে ছিলো? কে হতে পারে?
কেনো? অইদিনের একদিনের জন্য আমাদের সবার রাজা আমাদের “বোধন”।। আমরা অইদিন বোধন কে সাজাবো, উপস্থিত সব্বার সামনে আমাদের রাজাকে মানে বোধন কে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবো।।
খুব মজা!
এরপরে আমাদের জাগো সুন্দরের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। যে যার মতো সাজানো গুছানো। অনুষ্ঠানকে সফল করার এক বিরামহীন প্রয়াস। উদ্দেশ্য –আমাদের রাজা মানে বোধনকে ফুটিয়ে তোলা।।
তবে আমাদের বোধনের জাগো সুন্দরের একটা গল্প আছে। যেটা শ্রদ্ধাভাজন সোহেল আনোয়ার স্যার বলেছিলেন—-
” ‘জাগো সুন্দর চির কিশোর’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাটক। সেই নাটকের গান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে, বলা যায় ধার করে এই অনুষ্ঠানের নাম ‘জাগো সুন্দর’।
দীর্ঘদিন জাগো সুন্দর হয়ে আসছে বোধন আবৃত্তি স্কুলে। দিন দিন আমরা জাগো সুন্দরকে আরো আড়ম্বরপূর্ণ করে তুলছি। এর শিল্পী সকলেই বোধনের চলতি আবর্তনের শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের মঞ্চে অভ্যস্থ করে তোলার প্রয়াস ‘জাগো সুন্দর’। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজক। প্রত্যেকেই একক আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করেন। আবৃত্তি নিয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্যও থাকে তাঁদের জন্য। মূলত মঞ্চে সাহসের সঙ্গে, আত্মবিশ্বাসের সাথে দাঁড়ানোর একটি প্রাথমিক মঞ্চ ‘জাগো সুন্দর’।
জাগো সুন্দর। এই ‘সুন্দর’ হলো–
আমাদের ভেতরের চেতনা, আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা, আমাদের শিল্পীসত্তা, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের বোধ।
আমাদের প্রত্যাশা প্রত্যেক নবীন শিল্পীর ভেতর জেগে উঠবে আমাদের অন্তর্নিহিত এই মৌন সৌন্দর্য।
নজরুলের যে গানটি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আবৃত্তির এই নান্দনিক প্রয়োগপ্রচেষ্টা, সেই গানটি শিক্ষার্থীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই;
‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর
জাগো চির-অমলিন দুর্জয় ভয়-হীন
আসুক শুভদিন, হোক নিশি-ভোর॥
অগ্নি-শিখার সম সূর্যের প্রায়
জ্বলে ওঠো দিব্যজ্যোতির মহিমায়,
দূর হোক সংশয়, ভীতি, নিরাশা,
জড়-প্রাণ পাষাণের ভাঙো ঘুমঘোর॥
জাগো সুন্দর চিরকিশোর।'”
— সোহেল আনোয়ার স্যার বলেছিলেন, জাগো সুন্দরের ভাবনা কাজী নজরুল ইসলামের এই গান থেকে এসেছিলো। কিন্তু তারপরও কেন জানি না আমার সেদিন মনে হয়েছিল “আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে”।।
তো যা বলছিলাম এরপরে এক পা দু পা করে সময় এগিয়ে আসতে থাকে। আমাদেরও প্রস্তুতি চলতে থাকে।
মঞ্চ সাজ-সজ্জার চিন্তা, কবিতা সিলেকশন আরো কত কি!
আমাদের অবশ্য জাগো সুন্দরের একটা ভাবনা দেওয়া হয়েছিল বোধন থেকে । যে ভাবনার উপরে আমরা আমাদের এই সম্পূর্ণ জাগো সুন্দরটাকে সাজাবো।। আর তা হচ্ছে— “মুক্তিযুদ্ধ”।
এখানে মঞ্চ সাজানো হবে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ভাবনা দ্বারা, কবিতা আবৃত্তি যা হবে সবগুলোই হবে মুক্তিযুদ্ধের। আর সব্বার পোশাক হবে মুক্তিযুদ্ধের যে লাল স্বাধীনতার সূর্য, সেটিই অর্থাৎ লাল রঙ। ছেলেরা লাল রঙ্গের পাঞ্জাবী পড়বে আর মেয়েরা লাল রঙের শাড়ি।।
এই ভাবনাকে মাথায় রেখে আমাদের মঞ্চ সাজানোর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। লাল বৃত্তের মাঝখানে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, ডিঙ্গি নৌকোর এই ছোট্ট বাংলাদেশের মানচিত্রটি। উপরে একটু বাঁকানো করে সাজিয়ে লেখা ” জাগো সুন্দর”। নীচে আবার অনন্য ৫১, পাশে লেখা ” বোধন “। আবার মঞ্চের দুপাশে আমাদের স্মারক, আমাদের চিহ্ন লাল সবুজের বাংলাদেশের পতাকা । অর্থাৎ, আমাদের সেদিনের রাজা মানে বোধন কে উপস্থাপন করাটাই আমাদের লক্ষ্য।
দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এলো সেইদিন।। ৫ই জুলাই, শুক্রবার। অনুষ্ঠান স্থল, চট্টগ্রামের থিয়েটার ইন্সটিটিউট।
তো, অনুষ্ঠানের দিন এই মঞ্চ সাজানো হলো। খুব ভোরে গিয়ে ককশীট, রং তুলি দিয়ে তৈরি সব জিনিসগুলোকে হাত লাগিয়ে এক করে মঞ্চে উপস্থাপন। অবশ্য ককশীট আর রং তুলির কাজ আগেই করা ছিল। আমরা শুধু অইদিন গিয়ে ককশীট আর বাকি জিনিসগুলো দিয়ে মঞ্চ সাজিয়েছিলাম। নাহলে একদিনেই এতোসব ছবি আকাঁর কাজ করা যায় বুঝি?
আমাদের অনন্য ৫১ র সব্বার হাত লাগানোতে খুব অল্প সময়েই আমরা মঞ্চ সাজাতে পেরেছিলাম। রুপন দা, সুস্মিতাদি, তিথি দি, নার্গিস আপু, শহীদ, তারেক, সিনথিয়া, জিয়াত আমরা সব্বাই হাত লাগিয়েছিলাম তাতে। কি খুশি, কি আনন্দ আমাদের। আজ আমরা আমাদের ভালোবাসার বোধনকে সাজাবো বলে কথা। এখানে আমি কাকে ফেলে কার কথা বলবো। আমাদের সব্বার ই এই অনুষ্ঠানে ছোট ছোট ভালোবাসাগুলো ছিল। যার জন্যই এতবড়ো একটা কাজ খুব সহজেই হাসতে হাসতে, আড্ডা আর গল্প, কবিতার ফাঁকে শেষ করে স্মৃতি জমা করতে পেরেছিলাম।
আমাদের অনন্য ৫১ আবর্তনেরই কেউবা আবার আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন। আর এসবের পর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আসে তা হচ্ছে— আমাদের এই অনন্য ৫১ আবর্তনের সবার প্রথমবার মঞ্চে আবৃত্তি করা।
বাবারে বাবা! কিযে ভয় লাগছিলো। এত্ত খুশি, আমরা সাজলাম, আমরা সাজালাম, সব গুছালাম, কিন্তু এই মঞ্চে কেনো আবার সব। ভুলেই গিয়েছিলাম সোহেল স্যারের কথা টি। আমাদের মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করার ভীতি দূর করতেই এই জাগো সুন্দরের আয়োজন করা।
এরপরে বেলা ১১টা নাগাদ আমাদের আবৃত্তি পর্ব শুরু হয়। তবে শুরুতেই বোধন পরিবারের সবাই বোধনের প্রাণ পুরুষ, বাংলাদেশের বরেণ্য আবৃত্তিশিল্প, বোধন আবৃত্তি স্কুলের আমৃত্যু অধ্যক্ষ ছিলেন যিনি— সকলের শ্রদ্ধেয় রণজিত রক্ষিত স্যার’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করেছিলেন। রণজিত রক্ষিত স্যার বাংলাদেশের বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী, বোধনের প্রাণ পুরুষ ও বোধন আবৃত্তি স্কুলের আমৃত্যু অধ্যক্ষ ছিলেন।
বোধনের অনন্য ৫১ আবর্তনের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের কখনো কখনো মনে হয়, আমাদের বুঝি কিছুটা হলেও ভাগ্যটা খারাপ। কারণ, আমরা রণজিত রক্ষিত স্যারের সান্নিধ্যে যেতে পারিনি, আমরা তারঁ সেই ভালোবাসার জায়গাটুকু স্পর্শ করতে পারিনি।
এরপরেই কান্তা দি আর অনামিকা ছিলেন উপস্থাপনায়। উনারা যখন একটা করে নাম বলছিলেন তখুনি, বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছিলো। এই বুঝি উনারা আমার নাম বলবে। বাপরে বাপ! প্রথমবার মঞ্চে দাড়াতেঁ এত্ত ভয় করে ক্যান?
ওমা! দেখি অনন্য ৫১র সব্বার একি অবস্থা!
ভীষণ নার্ভাস। স্বাভাবিক, প্রথমবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা বলা। মোটেও সোজা কাজ নয়।।
একেবারে সব্বার শেষে আমাদের পাচঁজনকে মঞ্চে ডাকা হলো। আমি এবং আমার অন্য চার ভালোবাসার মানুষগুলো। যারা আমাকে এই জাগো সুন্দর অনুষ্ঠান নিয়ে সবসময়ই সবকিছুতে সার্পোট দিয়েছিলেন। রুপন দা, তিথি দি, নার্গিস আপু।
এরপরে কবিতা পর্ব শেষ। আমরা আমাদের মতো করেই চেষ্টা করেছি। মঞ্চে প্রথমবার আমাদের প্রয়াস আবৃত্তি করবার।
বিচারক সারিতে বসেছিলেন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন দিদি আর ভাইয়া — সুবর্ণা চৌধুরী আর ইসমাইল চৌধুরী সোহেল।।
উনারা আমাদের সবার আবৃত্তির শেষে যখন আমাদের ই করা সেই আবৃত্তি নিয়ে কিছু বলবেন তখন সবারই ভয়ে হাত পা সেধিয়ে যাচ্ছিল। আমি মঞ্চ থেকে দেখছিলাম উনারা দুজন দাদা-দিদি আমাদের কবিতাগুলো শুনে একটা খাতায় কিসব জানি লিখছিলেন। তাই ভয়টা আরো বেড়ে গিয়েছিলো, কি বলবেন উনারা? সবই তো ভুলই পড়েছিলাম।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সহ-সভাপতি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন দিদি সুবর্ণা চৌধুরী বলেন, “আজকের আয়োজনটি প্রশংসার দাবিদার। তবে প্রশিক্ষণার্থীরা নিজেদের আরেকটু পরিচর্যা করলে বোধের পরিসর বাড়বে। আমরা একটি অসম্প্রদায়িক, মানবিক ও সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে চাই।” আর এই কথাগুলোর বাইরেও দিদি আমাদের ছোট ছোট ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, আমরা যেভাবে ভয় পাচ্ছিলাম ওভাবে করেন নি। বরং, আমাদেরই করা ভুলগুলোর খুব মিস্টি এবং সহজভাবেই তুলে ধরেছিলেন।
মঞ্চে আমাদেরই উদ্দেশ্যে স্বাগত বক্তব্য রেখেছিলেন — সঞ্জয় দাদা, মৃন্ময় দাদা, গৌতম দা, অনুপম দাদা, বিপ্লব দা, সাজ্জাদ ভাইয়া, পলি দি ( পলি ঘোষ), শিশির দাদা, প্রতীম দা, সবুজ ভাই, আনোয়ার ভাইয়া ( সাজেদ আনোয়ার), অনন্যা ( অনন্যা পাল), জসিম ভাইয়া সহ বোধন পরিবারের সব্বাই।
এরপরে, ঘড়ির কাটায় যখন ৩টের ঢং ঢং শব্দ শোনা গেলো তখন জানি আমাদের সময়টা একেবারেই কমা সরিয়ে দাড়িই বসিয়ে দিয়েছিল। এখুনি এই অনুষ্ঠানস্থল থিয়েটার ইন্সটিটিউট থেকে যেতে হবে।
যাবো যাবো যখন করছিলাম সাথে আবার পেটের ক্ষুধার জন্য যখন সব বিরক্ত বিরক্ত লাগছিলো তখুনি তাতে আনন্দের খুশবু ছড়ালেন প্রিয় দুই দাদা — সঞ্জয় দাদা আর ইসমাইল সোহেল ভাইয়া।।
ওপার বাংলার বিখ্যাত শিল্পী কবির সুমনের গাওয়া সেই বিখ্যাত —- “আমি চাই” গানটি করেছিলেন।।
যে গানে মানুষের কথা বলা আছে, ভালোবাসার কথা বলা আছে।
সেই গানটির কথাগুলো উনারা দুই দাদা মিলে আবৃত্তি করেছিলেন আবার গানও করেছিলেন। মাঝে অবশ্য ঊনপঞ্চাশ আবর্তনের জলিল মিস্টি করে ছোট্ট একটি কবিতা শুনিয়েছিলো সব্বাইকে।
এরপরে আমরা আমাদের শ্রদ্ধাভাজন দুই দাদার কাছে মানুষের ভালোবাসার সেই গান “আমি চাই ” শোনার আনন্দ নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে আমাদের প্রশিক্ষণস্থান অপর্ণাচরণ স্কুলে গিয়ে হাসি ঠাট্টা আর গল্প আড্ডায় সব্বাই একসাথে দুপুরের ভোজন পর্বের ইতিটানার কাজটা সেরে ফেলি।
এরপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বোধনের কবিতা চর্চার সাপ্তাহিক আয়োজন ” কবিতায় কথা কই” এ অংশগ্রহণ।
তারপর বাসায় ফেরা।।
আমি সেদিন বাসায় এসে খানিকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। আকাশটা সেদিন মেঘলা ছিল। এই বুঝি খুব জোর বৃষ্টি নামবে। আষাঢ়ের আকাশ মেঘলা তো হবেই এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু, তারপরও আকাশের সাথে কোন জায়গায় আমার মিল ছিলো। আকাশটার জানি খুব মন খারাপ। আমারো তাই।
এই জাগো সুন্দর, জাগো সুন্দর করে আমার এবং আমাদের অনন্য ৫১ আবর্তনেরই কিছু দাদা-দিদির শেষ কয়েকটা দিন যাবত যে ছুটাছুটি, কাজের ফাকেঁ আমাদের খনিকের আড্ডা, আর অনুষ্ঠানের দিন রুপন দার বারবার গোফেঁ শান দেওয়া, সুস্মিতা দির কাজের ফাকেঁ হাসি- ঠাট্টা আর তাঁর চা খাওয়ানোর নাছোরবান্দা চেষ্টা , সব্বার মিস্টিমুখের মিস্টি হাসিতে মঞ্চ সাজানো, “এই এটা এভাবে দিলে ভালো হবে, না ওভাবে দেই”—- এইসব কথা মনকে ভারী করে তুলেছিলো। কারণ, এসবক’টা স্মৃতির বাক্সে জমা পড়েছে ততক্ষণে।
অনুষ্ঠান শেষে সবার ছবি তোলা, সবার এক ফ্রেমেতে বন্দি হওয়া, এ জানি এক ফ্রেমেতেই বোধন এরকম অবস্থা।
সত্যি তাই, আমরা সেদিন “এক ফ্রেমেতেই বোধন ছিলাম”।। আবার সেইসাথে “এক ফ্রেমেতেই বোধনের অনন্য ৫১আবর্তন ” ও বোধন ভালোবাসার, বোধন পরিবারের অংশ হয়েছিলো। সবথেকে মজার ব্যাপার ছিলো — আমরা অনন্য ৫১ আবর্তনের সবাইকে সেদিন এক করতে পেরেছিলাম। সবাইকে আনন্দ উচ্ছ্বলে ভরিয়ে দিতে পেরেছিলাম।
একটু গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে—
” ধিতাং ধিতাং বলে,
মাদলে তান তোলে—
আজ আনন্দ উচ্ছ্বলে আকাশ ভরে জোছনায়”
সত্যি তাই, গত ৫ই জুলাই থিয়েটার ইন্সটিটিউটে বোধনের আকাশ ভরে গিয়েছিল এই জাগো সুন্দরের আনন্দ উচ্ছ্বলে।।
এনিয়ে প্রাপ্তি কখনো খুজঁতে যাবো না আমরা কেউই । কিন্তু, কতটুকু গুছাতে পেরেছি নিজেদের তাই ই যখন ভাবছিলাম তখুনি— সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঠাসঁ করে একটা নোটিফিকেশন আসে। আর তাতে দেখি আমাদের শ্রদ্ধেয় সোহেল আনোয়ার স্যার ঢাকা থেকে আমাদের এই অনন্য ৫১র জন্য শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন অভিনন্দনের একটা ক্ষুদে ভালোবাসার চিঠি। তিনি ঢাকায় বসে আমাদের এই অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
এটা আমাদের কাছে, আমাদের এই অনন্য ৫১ আবর্তনের কাছে এক বিশাল প্রাপ্তি, এক বিশাল আশীর্বাদ, ভালোবাসা।
সাথে বোধনের অন্যান্য দাদা দিদি সব্বাই বলে উঠেছিলেন— মঞ্চটা খুব খুব ভালো ছিল। ইউনিক ছিল। ভালো ছিল পুরো আয়োজনটি। এও তো আমাদের কাছে এক বিশাল প্রাপ্তি, এও তো আমাদের আশীর্বাদই ছিল সবার থেকে পাওয়া। আর ছিল বোধনের সব্বার এক রাশ ভালোবাসা।
আর সবশেষে সবচেয়ে বেশি আনন্দ লেগেছিল যখন — আমাদের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, আমাদের দাদা, আমাদের স্যার, যিনি সবসময়ই সবকিছুতেই আমাদের পরামর্শ দেন, আমাদের আগলে রাখেন—- সঞ্জয় দাদা।। সঞ্জয় পাল।
তিনি যখন মঞ্চ দেখেই অনুষ্ঠানের দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুকে) ছবি পোস্ট করেছিল, আর সবশেষে তিনি ও যখন এনিয়ে অভিনন্দন বার্তা দিয়েছিলেন তখনই মনে হয়েছে — কিছুটা হয়তো পেরেছি আমরা সব্বাই, অনন্য ৫১ আবর্তনের সব্বাই। আমাদের রাজাকে অর্থাৎ বোধনকে মঞ্চে উপস্থাপন করতে, ফুটিয়ে তুলতে।।
পরিশেষে, আমাদের শ্রদ্ধেয় ইসমাইল ভাইয়া ( ইসমাইল চৌধুরী সোহেল) সবসময়ই বলতেন — শুদ্ধ বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে, বিকাশ ঘটাতে হবে শুদ্ধ চেতনার।।
বোধন তাঁদের এই জাগো সুন্দর অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মূল ভাবনা হিসেবে রেখে আমাদের সব্বার কাছে, সব্বার ভেতরে একটা বিষয়েরই জানান দিতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বোধনের আপোষহীন চলা এবং বোধনের শিক্ষার্থীদের বোধ বা চেতনার জায়গায় মহান মুক্তিযুদ্ধকে ফুটিয়ে তোলা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধারণ করা, সাথে এক অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নবোনা।।
অনন্য ৫১ আবর্তনের আমরা সব্বাই ই বোধনের এই মুক্তিযুদ্ধের ভাবনাকে মাথায় রেখে পুরো অনুষ্ঠানকেই সাজানোর চেষ্টা করেছি। সেই সাথে ছিল বাংলাদেশের বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী বোধনের প্রাণ পুরুষ প্রয়াত রণজিত রক্ষিত স্যারের হাতেগড়া এ প্রতিষ্ঠানটিকে ফুটিয়ে তোলার অবিরাম চেষ্টা ।। আমাদের সেদিনের সেই রাজা অর্থাৎ বোধন কে তুলে ধরা।।
আমরা শ্রদ্ধা জানাই দেশবরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী, বোধন আবৃত্তি স্কুলের আমৃত্যু অধ্যক্ষ ছিলেন যিনি, বোধনের প্রাণপুরুষ প্রয়াত রণজিত রক্ষিত স্যার প্রতি।।
৫ ই জুলাই বোধনের অনন্য ৫১ আবর্তনের এই জাগো সুন্দর নিয়ে বোধনের অনন্য ৫১ আবর্তনের ই আবৃত্তি শিক্ষার্থী হিসেবে আমি আমার সেদিনের সেই অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করলাম। আর সাথে আমাদের এই অনন্য ৫১ র সব্বার স্মৃতির থলে বা ঝুড়িতে কিন্তু দিনটির অসংখ্য স্মৃতি জমা পড়লো।
“বোধ থেকে বোধন কিংবা কিংবা আঁধার ভেঙ্গে আলোর বুনন।।”
আর আমরা বলি, আমাদের ভালোবাসায় বোধন। অনন্য ৫১ আবর্তনের আমাদের সব্বার চেষ্টা থাকবে সেই বোধের জাগরণ ঘটানো, সমস্ত আধাঁরকে ভেঙ্গে আলোর বুনন ছড়িয়ে দেওয়ার।
লিখেছেনঃ
ইভান পাল
অনন্য ৫১ আবর্তন
শিক্ষার্থী
বোধন আবৃত্তি স্কুল