শাকিলুর রহমান (মাগুরা)
আমাদের দেশে এমনিতেই বাল্যবিয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এখানে শতকরা প্রায় ৬৫ শতাংশ মেয়ের বয়স ১৮ পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। অর্থাৎ এ দেশে গড়ে প্রতি তিনটি বিয়ের মধ্যে দুটি বাল্যবিয়ে, আর এর অনিবার্য পরিণতি মেয়েদের অকাল-মাতৃত্ব। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে মা ও সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কাসহ নানাবিধ সামাজিক সমস্যা। মাগুরায় বাল্যবিয়ে হয়েছে এমন কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয় চ্যানেল আগামীর। বিলঝলমল গ্রামে সালমা বেগল চ্যানেল আগামীকে বলেন, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মা-বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। লেখা পড়া ছেরে সংসারে কাজ করতে হয় এখন। আমি বিয়ে করতে চাইনি লেখাপড়া করতে চেয়েছি হ। সংসারে অভাবে কারণে বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ বছর বয়সে মা হয়। এই অল্প বয়সে সন্তান, সংসার সামলাতে সে হাপিয়ে উঠছে। আমার ছেলে এখন অনেক অসুস্থ তাকে প্রতি সপ্তাহে ডাক্তার কাছে দেওয়া আগে এতে অনেক টাকা খবর হয়। এখন ঠিক মত খেতে পারি না। আমার জীবন থাকতে আমার সন্ততদের বাল্য বিয়ে দিব না। বিলঝলমল গ্রামে পিয়াকা চ্যানেল আগামীকে বলেন, বাবা মা আমাকে জোর করে তিন মাস আগে বিয়ে দিয়েছে। আমি ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করতাম। বিয়ে করতে চাইনি কিন্ত পরিবারের অভাবের কারণে বিয়ে করি। আমার দুই বোন এক ভাই। আমার ছোট ভাই অনেক অসুস্থ তার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়। আমার বাবা মাঠে কাজ করে যে টাকা পায় তা দিয়ে আমাদের সংবাদ চলে। আমার লেখাপড়া করার অনেক ছিল কিন্ত করতে পারলাম না।
কথা হয় একই গ্রামের সালাম মোল্লার নামের অভিভাবকের সাথে তিনি চ্যানেল আগামীকে বলেন,আমার পাচঁ বেয়ে এক ছেলে। দরিদ্রতার কারণে বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়েছে। তখন তার বয়স ১৩ বছর। আমরা ১৫ বছরে বয়সে একটি ছেলে হয় সে ছেলে সব সময় অসুস্থ থাকে। অভাব কারণে সংসার চলতে চাই না বলে মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়। আরো চার মেয়ে আছে তাদেরকে বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কষ্ট হলেও ১৮ বছর বয়স না হলে মেয়েদের বিয়ে দিব না। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখেও ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’ -এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নিরদেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ের বিধান রাখা হয়েছে। খসড়া আইনে বাল্যবিয়ে বন্ধে ‘কঠোর’ শাস্তির কথা বলা হলেও অপ্রাপ্তবয়স্করা বিয়ে করলে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের আটকাদেশ বা পাচঁ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এটাও খুবই মামুলি একটা ব্যবস্থা। এই আইন পাস হলে ওই ১৫ দিনের আটকাদেশের মধ্য দিয়েই কিছু বাল্যবিয়ে বৈধতা পেয়ে যাবে, যা বর্তমান আইনের চেয়েও বড় দুর্বলতা তৈরি করবে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছর আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের পাচঁ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। ১০-১৯ বছর বয়সের দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। সম্প্রতি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বাল্যবিয়ে নিয়ে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে,নিরাপত্তাহীনতার কারণে মা-বাবা প্রায় ২৬ শতাংশ মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। দারিদ্র্যের কারণে ১৯ শতাংশ এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে প্রায় ২৩ শতাংশ অভিবাবক মেয়েদের বিয়ে দেন বলে ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের এখনও ১৬ বছরের আগে ৬৫শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। এর মধ্যে শতকরা পাচঁ দশমিক ৭৯ ভাগের বিয়ে হয় পরিবারের অনুমতি ছাড়া।
মহম্মদপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছাঃ শিরিনা খাতুন চ্যানেল আগামীকে বলেন, মাগুরা জেলা প্রশাসন দুইটি পরিকল্পনা গ্রহন করে, একটি “মান সম্ভত শিক্ষা চাই” আর একটি “বাল্যবিবাহ মুক্ত সমাজ চাই”। মাগুরা জেলাকে খুব তাড়াতাড়ি বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হবে। সে উপলক্ষে মাগুরা জেলার সব উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এবং সব সরকারি কর্মকর্তা এক যোগে কাজ করছেন। বাল্য বিবাহ বন্ধ করা জন্য ১৫ হাজার লালকার্ড বিতরণ করা হয়েছে। মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সদস্য, সেচ্ছাসেবী মহিলা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতে উঠান বৈঠক করা হয়েছে ৪৬টি। উপকারভোগীর সংখ্যা প্রতিসভায় গড়ে ৫০ জন করে মোট ২৩০০ জন। উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ে হটলাইন চালু করা হয়েছে সেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফোন নাম্বার ও অফিসার ইনচার্জ মহম্মদপুর থানার নম্বর এবং মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার ফোন নাম্বার আছে। সেখানে সরাসরি ফোন করে অভিযোগ করতে পারবেন। বাল্য বিবাহ ও সন্তান ধারণের কুফল সম্পর্কে মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা অফিসার ডা. সুমিত কুমার বিশ্বাস চ্যানেল আগামীকে বলেন, অল্প বয়সে গর্ভধারণে মা ও শিশু দুজনেই ঝুঁকিতে থাকেন। কিশোরী মায়ের সন্তানরা বেশিরভাগ সময় অপুষ্টিতে ভোগে। শিশু জন্মের সময় মৃত্যু হতে পারে। মা ও শিশু শরীরে রক্ত অভাব দেখা দেয়। শিশু প্রতিবন্ধি হতে পারে।
