মো. মেহেদী হাসান, গাইবান্ধা:
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল সম্প্রদায় নিজস্ব ঐতিহ্যে নেচে-গেয়ে আনন্দের সাথে বরণ করলেন ঋতুরাজ বসন্তকে। নিজস্ব কৃষ্টি বাহা পরবে মাতলো গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল পল্লী বাগদা বাজার কাটাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন মাঠে বাহা পরব বা বসন্ত উৎসবে মেতে ওঠে আদিবাসী সাঁওতালরা। শনিবার (০৭ এপ্রিল) বাহা পরব উদযাপন কমিটি, এনডিএফ ও পারগানা পরিষদের আয়োজনে উৎসবে ইউএনডিপি-হিউম্যান রাইটস্ প্রোগ্রাম ও অবলম্বন পৃষ্ঠপোষকতা করে। নেচে-গেয়ে আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতিতে বাহা পরবের মাধ্যমে বরণ করেন ঋতুরাজ বসন্তকে।
দিনভর ধর্মীয় পুজা-অর্চনা ও উত্তর জনপদের জনপ্রিয় সাঁওতাল সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক সাঁওতাল নারী-পুরুষ-কিশোরী অংশ নেন। বিভিন্ন বর্ণের আদিবাসী-বাঙালিদের আগমনে মিলন মেলায় পরিণত হয় গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী।
পরে স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীদের পাশাপাশি আমন্ত্রিত সাঁওতাল সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা দর্শকদের মুগ্ধ করেন। এতে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ৬টি ইউনিয়নের ৮টি সংস্কৃতিক দল অংশগ্রহণ করে।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল হত্যার প্রায় দেড়বছর পর এই উৎসবের আয়োজন করা হলো। দীর্ঘদিন পর এ ধরনের উৎসবের সুযোগ পেয়ে সাঁওতালরা সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত উৎসবের মহড়া দিতে থাকে। উৎসবের জন্য কেনা হয় নতুন কাপড়। উৎসবস্থল আদিবাসীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া সম্বলিত ফেস্টুনে সুসজ্জিত করা হয়।
এতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র পাঠ করে আদিবাসী যুবক আন্দ্রিয়াস মুরমু ও মানবাধিকার সনদ পাঠ করেন প্রিসিলা মুরমু। সকালে পুজা-অর্চনার পর বাহা পরবের প্রথম অংশে আলোচনা সভা ও পরে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল, বক্তব্য রাখেন, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) রাফিউল আলম, গাইবান্ধা জেলা উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদের আহবায়ক এ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু, কাটাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক, এনডিএফ এর নির্বাহী পরিচালক ভিক্টর লাকরা, অবলম্বনের নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী, পারগানা পরিষদের সভাপতি রুসন কিসকু, আদিবাসী গবেষক কেরিনা হাসদা প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন বাহা পরব উদযাপন কমিটি আহবায়ক ফিলিমন বাস্কে।
বসন্ত ঋতু আসলেই গাছে গাছে নতুন ফুলের সমারোহ প্রকৃতি প্রিয় মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। শিমুল, পলাশে শোভায় প্রকৃতি নিজেকে নতুন রূপে প্রকাশ করে। আদিবাসী সাঁওতালরাও বসন্তকে বরণ করে নেয় তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য দিয়ে। এসময় সাঁওতাল তরুনীরা নতুন নতুন ফুল তাদের খোঁপায় গেঁথে আনন্দে নাচে-গানে মেতে ওঠে। সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে চলে আনন্দ উৎসব। বাড়ি বাড়ি তৈরি হয় হাঁড়িয়া। সবাই হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দে বিভোর হয়ে মাদলের তালে তালে গাইতে থাকে, নাচতে থাকে। আর সেই আনন্দ-উৎসবের নাম ‘‘বাহা পরব’’।
আদিবাসী সাঁওতালদের অন্যতম একটি প্রধান পার্বণ হচ্ছে ‘‘বাহা উৎসব’’ বা বাহা পরব। বাহা অর্থ ফুল। তাই বাংলায় বাহা পরবকে ‘‘ফুল উৎসব’’ বলা হয়। মূলত, নববর্ষ হিসেবে ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী-সাঁওতালরা। উত্তরাঞ্চলে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে উড়াও, মুন্ডা, মালো, মাহাতো, মালপাহাড়ী, রাজওয়ারসীসহ মোট ৩৮ টি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী এই বাহা উৎসব পালন করে থাকে।
বাহা পরবের মূল কথা হচ্ছে এই পরব না করা পর্যন্ত সাঁওতাল মেয়েরা সারজম বাহা (শাল ফুল), ইচাক বাহা, মুরুপ বাহা এগুলো খোঁপায় দিতে পারেনা। এই পরবের মধ্য দিয়েই নতুন বছরের ফুল, ফল, পাতাকে সাঁওতাল আদিবাসীরা ব্যবহার করতে শুরু করে।
বাহা পরব ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হয়ে থাকে। গ্রামের মানঝি (গ্রাম প্রধান) পরবের দিন ঠিক করে। দুই-তিন দিনব্যাপি চলতে থাকে পরব। বাহা পরবের জন্য নির্দিষ্ট একটি পূজার স্থান থাকে। একে সাঁওতালরা জাহের থান বলে। তিনটি ছোট ছোট খড়ের ঘর দিয়ে জাহের থান তৈরি হয়। গ্রামের নাইকে অর্থাৎ পুরোহিত পরিস্কার ধুতি পড়ে পূজা থানে যান। নাইকের হাতে কাঁসার থালাতে থাকে নতুন নতুন ফুল। এসময় সাঁওতাল তিন দেবতা জাহের এঁরা (ফুলের দেবী), মারাঙবুরু (সাঁওতাল দেবতা প্রধান), পারগানা বঙ্গা (এলাকার দেবতা) এর পুজা করেন নাইকে।
গ্রামের নাইকে অর্থাৎ পুরোহিত মঙ্গল টুডু বলেন, সাঁওতালদের বেশ কয়েকজন দেবতা রয়েছে যাদের মধ্যে জাহের এঁরা (ফুলের দেবী), মারাঙবুরু (সাঁওতাল দেবতা প্রধান), পারগানা বঙ্গা (এলাকার দেবতা)। এই দেবতা বাড়ীতেও থাকে বাড়ীর বাইরেও থেকে ডিউটি দেয়। আমরা বিশ্বাস করি। এজন্য এই দেবতাদেরকে আমরা এই মাসে নতুন শাল ফুল দিয়ে পুজা দেই। আর পুজা দেয়ার পরেই আমরা নতুন ফুল, ফল ছিড়ি।
বাহা পুজার উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে যে, আমরা যেন আজ থেকে সারাবছর ভালাভাবে চলতে পারি। আমাদের যেন কোন অমঙ্গল না হয়, কষ্ট না হয় আর এই আনন্দ যেন সারাবছর সবার সাথে একই রকম থাকে।
বাহা উৎসব সম্পর্কে আদিবাসী গবেষক কেরিনা হাসদা বলেন, বাহা পরব বা উৎসব সমতলের সবচেয়ে সংখ্যাদিখ্য আদিবাসী জাতি সাঁওতালদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। বাহা মানে ফুল। ফুল উৎসব যতক্ষন না আদিবাসীরা করতে পারেন ততক্ষন পর্যন্ত আদিবাসীর সমাজে নতুন ফুল ব্যবহার করা হয় না। আর মেয়েরাও তাদের খোপায়-মাথায় এই ফুল দিতে পারবে না। এ দেশের প্রকৃতির সাথে আদিবাসী সমাজ মিশে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, যেভাবে বনজঙ্গল উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং আদিবাসীরা যেই জায়গা থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী এসব সংস্কৃতি আগের সেই জৌলুস হারাতে চলেছে।
আর সেই কারনে অনেক সাঁওতাল আদিবাসীরা এই উৎসব পালন করতে পারছে না। এভাবে আদিবাসী সংস্কতি ধ্বংস হতে থাকলে আদিবাসীরাও একদিন হারিয়ে যাবে। তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখতে ও তাদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতেই এই বাহা উৎসব পালন করে থাকেন আদিবাসীরা। আর শুধুমাত্র সাঁওতালরাই নয় উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উড়াও, মুন্ডা, মালো, মাহাতো, মালপাহাড়ী, রাজওয়ারসীসহ মোট ৩৮টি জাতি গোষ্ঠী এই বাহা উৎসব পালন করে থাকে।
অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম বলেন বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষা আর বহু জাতির সম্মিলনে বাংলাদেশ একটি জাতি- বৈচিত্র্যের দেশ। এ দেশের পাহাড় থেকে সমতলে ৪৫টি আদিবাসী জাতি বাস করে- যাদের রয়েছে স্বতন্ত্র্য ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি। সংখ্যায় প্রায় ২৫ লক্ষাধিক, যা মূল বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রায় ২ ভাগ। এদেশের বৈচিত্র্যময় আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংখ্যাগুরু বাঙালিদের পরিচয় নেই বললেই চলে। প্রধান জনগোষ্ঠীর অবহেলা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাবে আদিবাসীদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি আজ প্রায় বিপন্ন। কিছু কিছু এর মধ্যেই হয়ে গেছে বিলুপ্ত।
বাহা পরব উদযাপন কমিটি আহবায়ক ফিলিমন বাস্কে বলেন, আমরা প্রকৃতিকে ভালোবেসে সাঁওতাল আদিবাসীরা বাহা উৎসব পালন করি। এই বাহা উৎসবের পুজা পার্বন করলে আমাদের সমাজ ও পরিবারের উন্নয়ন হবে। বাহা পুজা না করা পর্যন্ত আমাদের আদিবাসী সাঁওতাল নারীরা বাহা ফুল অর্থাৎ শাল ফুল ছিড়েও না মাথায় পরেও না। বছরের শুরুতে যেই নতুন ফুল ফুটে বা যেই এলাকায় যেই ফুল পাওয়া যায় সেই ফুল দিয়েই এই বাহা উৎসব পালন করা হয়। আর নতুন প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে শিখবে ও দেখবে এবং যাতে ভবিষ্যতে এই ঐতিহ্যবাহী বাহা পরব নষ্ট না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখবে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল বলেন, আদিবাসীরা আদিবাসীরা আমাদের এ’দেশেরই নাগরিক। তাদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য এ’দেশের সংস্কৃতিরই অংশ। তাদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে।