ইভান পাল
আজ ১লা ফাল্গুন। ঋতুবৈচিত্র্যের এই ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকোর বাংলাদেশে ১লা ফাল্গুন মানেই হলো বসন্ত।
শীতের প্রকৃতিতে যখন সবকিছু কনকনে ঠান্ডায় নির্জীব আর প্রাণহীন হয়ে পড়ে, তখন সেই প্রাণহীন প্রকৃতিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে আগমন ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের।
এসময় প্রকৃতিতে আনন্দ আর আনন্দ। আর প্রকৃতির সেই আনন্দ কে মানবকুল ও গায়ে হাতে মাখিয়ে বলে—-
“ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত”।
তখন প্রকৃতির সেই মধুমাখা আনন্দ ছড়িয়ে যায় দিক বিদিক। মানবকুল আর প্রকৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরে আসে। প্রাণের সঞ্চার ঘটে মানবমনে। মনে হয় যেনো চারিদিকে প্রাণের মেলা বসেছে।
আর প্রাণের এ উৎসব কে স্বাগত জানাতে বাংলাদেশ বসন্ত উদযাপন পরিষদ গত প্রায় ২২ বছর যাবৎ বসন্ত উৎসব কে উদযাপন করে আসছে। এছাড়া ও বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি বেসরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও অত্যন্ত সাড়ম্বরের সাথে বসন্তকে বরণ করে নিচ্ছে।
চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন “বোধন আবৃত্তি পরিষদ”।
সংগঠনটি গত প্রায় এগারো বছর যাবৎ চট্টগ্রামে এই বসন্ত উৎসব কে অত্যন্ত বর্ণিলভাবে এবং বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপন করে আসছে।
আর প্রতিবারের মতো এবারো “বোধন আবৃত্তি পরিষদ” অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আয়োজনে বসন্ত কে স্বাগত জানিয়েছ।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অনিন্দ্য প্রাকৃতিক নিসর্গ আমবাগান সংলগ্ন রেলওয়ে জাদুঘর শেখ রাসেল উদ্যানে “নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে ~ বসন্ত উৎসব ১৪২৫” এই শ্লোগানে অত্যন্ত সাড়ম্বরের সাথে বর্ণিলভাবে বোধন বসন্ত কে স্বাগত জানিয়েছে।
আর এবারের বসন্ত উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে বোধন আবৃত্তি স্কুল চট্টগ্রাম এর সাবেক অধ্যক্ষ বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী প্রয়াত রণজিৎ রক্ষিতের স্মরণে।
এদিন সকাল ৮টায় বসন্ত উৎসবের আহবায়ক ও বোধন আবৃত্তি পরিষদের স্থায়ী পরিষদের মুখ্য সমন্বয়ক সোহেল আনোয়ারের আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
এরপর বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কাবেরী সেনগুপ্তার পরিচালনায় সংগীত ভবনের শিল্পীরা দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ঋতুরাজ বসন্তের আবাহন করেন।
আর এরপরেই মঞ্চে বসন্ত বন্দনায় মাতেন বিশিষ্ট শিল্পী প্রিয়তোষ বড়ুয়া এবং তারঁ দল। এসময় তারঁ পরিচালনায় অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করেন “ভায়োলেনিষ্ট চিটাগাং ”এর শিল্পীরা।
আর তারপর কখনো গানে কিংবা কখনো নৃত্যের ছন্দের মূর্ছনায় বোধন আবৃত্তি পরিষদ এর বসন্ত উৎসব মাতান চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পীরা।
অনুষ্ঠানে একক সংগীত পরিবেশন করেন~ শিল্পী ডাঃ অনিন্দিতা চৌধুরী, শীলা চৌধুরী,অনুপম দেবনাথ পাভেল, বৈশাখী নাথ, তাসপিয়া হাসান, রিয়া দাশ, প্রিয়া ভৌমিক, নৈঋতা মন্ডল, সাদিয়া নাসরিন।
এরপর সূর্য টা পুব দিক থেকে মাথার উপর গড়াতেই পশ্চিমের দিকে যখন হাওয়া দিচ্ছিল তখন ঘড়ির কাটায় সময় টা বিকেল ৩টা।
আর ঠিক তখন ই আয়োজন করা হয় বোধনের প্রারম্ভিক ঐতিহ্য বসন্ত র্যালি। বিভিন্ন রঙ্গ বেরঙ্গের ফেস্টুন, ব্যানার, মুখোশ নিয়ে বসন্ত র্যালির আয়োজন করা হয়। সাথে ছিল বাংলার ঐতিহ্যগত বাদ্য— ঢোল। ঢোলের সাথে সাথে বোধন আবৃত্তি পরিষদের বসন্ত র্যালি উদযাপিত হয়।
আর এরপর পরই বিকেলের অধিবেশন শুরু হয়। এসময় সংগীত পরিবেশনায় ছিলেন — সংগীত শিল্পী রিষু তালুকদার, সঞ্জয় পাল, সোমা রায়, অজান্তা দাশ টুম্পা, কাবেরী সেনগুপ্তা, শুভাশীষ চৌধুরী, সানি ধর, সুমন সেন, সুমিত্রা বিশ্বাস, প্রিয়াংকা দাশ, প্রিয়া ধর এবং শুভ দাশ ।
কথামালায় ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ গাজী সালাউদ্দীন ও চ্যানেল আই ব্যুরো প্রধান চৌধুরী ফরিদ।
কথামালায় অতিথিরা বলেন, “পাহাড়তলীর এ স্থানটি অত্যন্ত পূর্ণ ও তাৎপর্যময়। এখানে প্রীতিলতার সংগ্রাহী মুহুর্ত মিশে আছে। এ রকম আয়োজন করায় বোধন আবৃত্তি পরিষদ সাধুবাদ জানাতে কোনো দ্বিধা নেই”।।
দলীয় নৃত্যে মঞ্চ মাতিয়ে রাখেন— নৃত্যরূপ একাডেমী, নৃত্য নিকেতন, দীপ শিখা নৃত্য গোষ্ঠী, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, নৃত্যনন্দন।
শিল্পী রণধীর দাশ এর পরিচালনায় বংশীর ধ্বনির শিল্পীরা বংশীবাদনে অংশ নেন।
একক নৃত্যে ছিলেন তৃষা আকতার মীম।
দলীয় সংগীত পরিবেশনায় ছিলো— বাগীশ্বরী সংগীতালয়, সুরপঞ্চমী সংগীত একাডেমী।
অনুষ্ঠানে একক আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী সুবর্ণা চৌধুরী, হাসান জাহাঙ্গীর, দেবাশীষ রুদ্র এবং অনুপম শীল।
আর অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন — ইসমাইল সোহেল, গৌতম চৌধুরী, বিথিকা বসাক, সাজ্জাদ চৌধুরী, মুক্তা বড়ুয়া, পুনম দাশ।
রবিঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ এবং হুমায়ুন আজাদের শুভেচ্ছা কবিতা আবৃত্তি করেন বোধন আবৃত্তি পরিষদের আবৃত্তিশিল্পীরা।
আর অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসে বন্দর ব্যান্ডের সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী বোধন আবৃত্তি পরিষদের উদ্যাগে আয়োজিত বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
উল্লেখ্য, আশির দশকে স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু এবং নির্যাতন উপেক্ষা করে বোধন আবৃত্তি পরিষদের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই সংগঠনটি তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেই চলেছে। বোধনের মতে, “বোধ থেকে বোধন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে সর্বস্তরের মানুষ কে “আধারঁ ভেঙ্গে আলোর বুনন” – এ সম্পৃক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় সূর্যোদয়ের পথে”।।