ইভান পাল
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,
তাই হেরি তায় সকল খানে॥
বাংলাদেশের বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী এবং যিনি দীর্ঘ সময় যাবৎ বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি ছিলেন, বোধনের প্রাণের মানুষ রণজিৎ রক্ষিতের প্রথম প্রয়াণ দিবসে “প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে” শিরোনামে দুই দিনের স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে “বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম”।। আজ প্রথমদিন মঙ্গলবার নগরীর থিয়েটার ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে কাকুর ডায়েরি থেকে আবৃত্তি এবং এ ডায়েরি একটি কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
সৌহার্দ্যের সম্মিলনের এ মানুষটি বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বোধন আবৃত্তি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ এবং আমৃত্যু অধ্যক্ষ ছিলেন।
এ স্মরণানুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, আবৃত্তিশিল্পী ও প্রশিক্ষক ড. ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, সরকারি চারুকলা কলেজ, চট্টগ্রাম এর সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর রীতা দত্ত, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর সেনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি সোহেল আনোয়ারের সঞ্চালনায় মোড়ক উন্মোচনে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি আনন্দমোহন রক্ষিত ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক রাশেদ হাসান।
কথামালা পর্বে কথামালায় অতিথি ড. ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ১৯৮৭ সাল থেকে বোধনের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছি। তখন চট্টগ্রামের মুসলিম হলের সম্মুখে স্বৈরাচার বিরোধী অনুষ্ঠানে তাঁকে আমি খুব কাছ থেকে পেয়েছি। তখন থেকেই রণজিৎ দা আমার বয়সে বড় হলেও তিনি সবসময় আমাকে বড় পরিসরে দেখতে চাইতেন। তাঁরই হাত ধরে আজ বোধন আবৃত্তি অঙ্গনে পথিকৃত। তিনি বোধনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। মানুষ হিসেবে এত বিনয়ী তাঁর সান্নিধ্যই যে অনন্য। তাঁর বিকল্প তো আমি কাউকে দেখি নাই। তিনি এ সংস্কৃতি অঙ্গনকে তিনি আরো কিছু দিতে পারতেন।”
কবি আবুল মোমেন বলেন, “আমাদের ছাত্রজীবনের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সবার মধ্যে ভালো করার ভেতরকার প্রতিযোগিতা চলতেন। তখন আবৃত্তি নিয়ে তেমন আলোচনা হতো না। তখন রণজিৎদা একটি আবৃত্তি করেন। তাঁকে আমি সেই আগাগোড়া মানুষ হিসেবে দেখেছি। আজকাল মানুষগুলো অনেক চালাকচতুরভাবে দেখছি। এ চতুর মানুষগুলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। কিন্তু রণজিৎদার মতো সরলমনা মানুষগুলো ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেতেন। তাঁর রুচিবোধ ও বিশ্বাস ভালোবাসায় তাঁর বন্ধুত্বতায় অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি বোধনকে আবৃত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন।”
এতে আরও বক্তব্য রাখেন বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম সাধারণ সম্পাদক এসএম আবদুল আজিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের সহসভাপতি সুবর্ণা চৌধুরী।
পরে আমন্ত্রিত আবৃত্তিশিল্পীরা কাকুর ডায়েরি থেকে একক আবৃত্তি পরিবেশনায় অংশ নেন আবৃত্তিশিল্পী সঞ্জীব বড়ুয়া, শুভ্রা বিশ্বাস, রাশেদ হাসান, রেখা নাজনীন, কংকন দাশ, নিশাত হাসিনা শিরিন, দেবাশীষ রুদ্র, হাসান জাহাঙ্গীর, সুমন বিশ্বাস, মুবিদুর রহমান সুজাত, সেলিম রেজা সাগর, লুবাবা ফেরদৌসী সায়কা, আল ইমরান, এহতেশামুল হক, উমেসিং মারমা, মেজবাহ চৌধুরী ও নাহিদ নেওয়াজ। এছাড়াও বোধনের আবৃত্তিশিল্পী ইসমাইল চৌধুরী সোহেল, সঞ্জয় পাল ও মৃন্ময় বিশ্বাস।
উল্লেখ্য, বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী রণজিৎ রক্ষিত চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সহ-সভাপতি ছিলেন। আমৃত্যুকাল বোধন আবৃত্তি স্কুলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় নগরীর আগ্রাবাদে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষ করে লিফটে নামার সময় বরেণ্য এই শিল্পী হৃদরোগে আক্রান্ত হন।। এরপর টানা এক সপ্তাহ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
আর অবশেষে গতবছরের ৩০ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে মৃত্যুর কাছে হার মানেন বোধনের প্রাণ পুরুষ রণজিৎ রক্ষিত।।
রণজিৎ রক্ষিতের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে। বাবা বিপ্লবী যতীন্দ্রমোহন রক্ষিত ও মা রানি রক্ষিত।
অংশগ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে।। ১৯৬৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারে নিয়মিতভাবে কাজ করতেন। অভিনয় করেন চারটি টেলিফিল্মে।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে তিনি সম্মানিত হন বারংবার। শুধু এই বাংলাতেই নয় ওপার বাংলাতেও সমান কদর ছিল গুনী এই শিল্পীর। ওপার বাংলার বিভিন্ন আবৃত্তি অনুষ্ঠানেও দেখা যেত গুনী এই শিল্পীকে।।
তিনি মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে দীর্ঘ ৪১ বছর জীববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন।
আর বোধন তাঁর কাছে ছিল প্রাণের জায়গা। তাঁর আরেকটি পরিবার, আরেকটি ভালোবাসার জগৎ।।
বোধনের প্রতিটি সদস্যের কাছে রণজিৎ রক্ষিত ছিলেন তাঁদের সবথেকে কাছের মানুষ।। তাঁদের প্রাণের মানুষ।।