আশিক সরকার
জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তার যে জানাজাটি হয়েছিলো সেখানে দাঁড়াবার সুযোগ হয়েছিলো আমার। ওইসময়ে অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছিলো। ৫ টাকার একটা নোট খরচ করতে গেলেও পাঁচবার ভাবতাম। আমার বাসা থেকে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের দুরত্ব প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটারের মত হলেও আমি পুরোটা রাস্তা তাই পায়ে হেটে গিয়েছিলাম।খুব রোদ ছিল সেদিন। প্রথমে গিয়েছিলাম শহীদ মিনারে। অনেক সেলিব্রেটি মুখও দেখেছি সেদিন। দেশের অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত এসে উপস্থিত সেখানে । গাড়িটা থেকে দরজা খুলে বেরিয়েই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ছুটলেন। আমি তখন লাইনে দাঁড়ানো। প্রায় সবার হাতে কদম ফুল। আমার হাতে ছিল না কিছু তার কফিনে রেখে আসার মত। ভেতরে যখন ঢোকার সুযোগ হল, তখন নুহাশকে দেখলাম হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে তার বাবার কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। বোঝা যাচ্ছে খুব কান্না করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কান্না করার পরের স্বাভাবিক চেহারাটি সবসময়ের স্বাভাবিক চেহারার মত নয়। এই চেহারায় এক রকম অদ্ভূত অসহায়ত্বের ছাপ থাকে।নুহাশকেও তেমনটি দেখাচ্ছে। তার দাদীও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ,কিছুক্ষন পরপর গোঙানোর মত শব্দ করে তিনি ছেলের লাশের কফিন জড়িয়ে ধরছিলেন… সাথে ছিল অন্যান্যরাও.. এগুলো আজ থেকে প্রায় ৫ বছর আগের কথা।হঠাৎ করেই দেখলাম বাংলাদেশে যে কয়টি চ্যানেল আছে তার সবগুলোতে ব্রেকিং নিউজ চলছে। একদল অদ্ভুত মাথার পাগল ছেলেমেয়ে হঠাৎ করেই কাঁদতে কাঁদতে ছুটোছুটি শুরু করে দিলো। হুমায়ূন আহমেদ নেই… আর নেই হুমায়ূন আহমেদ.. রাতবিরাতে ঢাকার রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে ভবগুরের মত ঘোরা হিমুরা ছুটে এলো।এসেছে রুপারাও, তবে সেদিন সবাই নীল শাড়ী পড়ে আসেনি। গলির চা দোকানের সিগারেট ফুঁকতে থাকা বাকের ভাইরা মটর সাইকেলে করে দলবল নিয়ে দৌড়ে এলো। ছুটে এলো মোনারাও। এক অদ্ভূত বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে দেখলো সে কাঠের বাক্সটিকে,যেখানটার ভেতর তাদের স্রস্টাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে.. একসাথে কেঁদে উঠলো হিমু রুপা আর বাকের ভাইরা… তাদের স্রস্টা আর ফিরবেনা। আর কোনদিনই ফিরবেনা… মিসির আলী, হিমু,রুপা, বাকের ভাই,মোনা, শুভ্র এরা সবাই হঠাত করেই বইয়ের পাতার ভেতর আটকে গেল। আর কখনোই এরা কখনো কথা বলবেনা। বাকের ভাইয়ের জন্য মোনা অপেক্ষা আর করবেনা। রুপা একা জানালায় দাঁড়িয়ে থাকবেনা আর.. কারন হিমু কোনদিন ফিরবেনা.. সবাই একটি জায়গায় এসে আটকে গিয়েছে.. কেউ কথা বলবেনা আর.. পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকবে.. কেউ আর কথা বলাবেনা তাদের দিয়ে… এখনো একদল পাগল ছেলে হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে রাতের ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় হাটে। একদল মেয়ে রাতে নীল শাড়ী পড়ে হয়তো এখনো ছাদে গিয়ে জোৎস্নাস্নানে মগ্ন হয়ে যায়। এসব সম্ভব কখনোই হতনা যদি হুমায়ূন আহমেদ নামের এই লোকটি পৃথিবীতে না আসতেন.. আজকের দিনে তিনি পৃথিবীতে আসেননি। পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলেন। মিসির আলী, হিমু,রুপা, বাকের ভাই,মোনা, শুভ্র সবাইকে একা করে দিয়ে ছেড়ে গিয়েছিলেন… অনেক দোয়া তার জন্যে। সকল মিসির আলী, হিমু,রুপা আর বাকের ভাইদের পক্ষ থেকে দোয়া… ভালো থাকুক তিনি…