সুরাইয়া হেনাঃ
“মা ঘর থিকা বাইর হইতে নিষেধ
করছে মনে নাই?”
চোখ কপালে তুলে জানতে চায় তপু। ওর
কথা শেষ হতেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে নোটন আর ছোটন।
“এতো ভীতু কেনরে তুই? এতো ভীতু হইলে চলে? স্কুল বন্ধ কবে থিকা,এখনিই তো খেলার সময়” বলে নোটন।
ছোটনও হুবহু নিজের মত
দেখতে ভাইটার সাথে সায় দে। “স্কুল
মিলিটিরিরা দখল করছে জানোস?” ফিসফিসিয়ে বলে তপু।
ওর চোখে মুখে মন খারাপের ছাপ। বিষ্ময় আর ভয়ও। ছাপটা ফুটে ওঠে নোটন,ছোটনের মুখেও। খানিকক্ষণ সবাই চুপ করে থাকার পর ছোটন বলে “আগে স্কুল বন্ধ থাকলে ভালোলাগতো। এখন লাগে না। সবার কথা মনে পড়ে। আমাগো রশিদ ছাররে নাকি মাইরা ফেলছে! শুনছস তোরা?”
“হু,সালমা আফারেও
নিয়া গেছে ওরা” মন খারাপের
স্বরে বলে তপু। নোটন
গলা খাকিয়ে বলে ওঠে “আমরা যুদ্ধ
করুম।” ছোটনের মাঝেও উৎসাহ
দেখা যায়। তবে তপু ঠিক সাহস
পেয়ে ওঠে না। ‘ওরা যুদ্ধ
করবে কিভাবে! মিলিটিরিগো তো বড় বড় পিস্তল আছে। ওগো তো কিছুই নাই!’ ব্যাপারগুলো ভাবায় ওকে। নোটন বলে চলে “শিহাব ভাই,অপু ভাই আরো অনেকে মিলা যুদ্ধ করতাছে। লিপি আফা,শিউলি আফা আর তাগো সখিরাও আছে সাথে।
তাইলে আমরা পারুম না কেন? আমরাও তো বড় হইছি।
(২)
সন্ধ্যা মিলাতেই মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঘর ছাড়ে নোটন আর ছোটন। বাড়ির পেছনের পথ ধরে চলে তপুর বাড়ির দিকে। তপু তখন বাড়ির পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে। হাতে ওর দাদার
বানানো লাঠি। ‘যুদ্ধে যাবে,খালি হাতে কি যাওয়া যায়!’
তিনজনে খুব সাবধানে পৌঁছোয় রহমান চাচার বাড়িতে। কয়েকবার দরজায়
কড়া নাড়ার পর রহমান চাচা ওপাশে দুবার খুক খুক করে কেশে প্রশ্ন করে। “কে?কে?”
তিনজনে একসাথে বলে ওঠে “আমরা। নোটন,ছোটন আর তপু।”
চাচা দরজা খুলে দেন,ওরা ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আবার দরজা বন্ধ করে দেন। কাধেঁ ঝোলানো চাদরের এক অংশ ধরে চশমার ডান কাচ পরিষ্কার করতে করতে উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করেন “এই সন্ধ্যা রাইতে এইখানে কেন
তোরা?”
“শিহাব ভাই আর তার দল কই
চাচা? আমরা তাগো লগে যুদ্ধে যামু”।
রহমান চাচা নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল
চেপে ইশারায় চুপ করতে বলে ছোটনকে।
তারপর তার পেছনে আসার নির্দেশ দেন।
বাধ্য ছেলের মত তাকে অনুসরণ
করে এগিয়ে যায় দেশের
প্রতি মমতাময়ী তিন সাহসী বালক।
ভেতরের সবাই আগে থেকেই সর্তক ছিলো। মিলিটারি হলে কি করবে তার প্রস্তুতিও ছিলো। দুষ্টু জমজ ভাই নোটন,ছোটন আর ওদের শান্ত বন্ধু তপুকে সবাই চেনে। ওদের দেখে হাফ ছেরে বাঁচে সবাই। তবুও দুশ্চিন্তা পুরোপুরি কাটে না। দল প্রধান শিহাব রহমান চাচার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাড়ে।
রহমান চাচা শান্ত স্বরে বলে-
“ওরা আসছে তোমাদের সাথে মিলা যুদ্ধ করতে যাওয়ার লাইগা। ভালোভাবে বুঝাইয়া বাড়িত পাডাও। রাইত বাড়লে পোলাপাইনগুলার বাপ মায় চিন্তা করবো।”
(৩)
বাঁশের কঞ্চি বাঁকিয়ে বানানো চাকাটা ছোট লাঠির সাহায্যে সামনের
দিকে ছোটাচ্ছে ছোটন। নোটন ডান
হাতে ধরা তপুর দাদার বানানো লাঠিটা মাটিতে ছুঁয়ে লাফিয়ে সামনের দিকে আগাচ্ছে। এমন খেলা আগে কখনো খেলেনি ওরা। তপুও হয়তবা খেলার অংশ হতো। তবে ভীতু ছেলেটাকে ওরা সঙ্গে আনেনি। যদিও ও আসার জন্য জোর করেছিলো,তবে মায়া হচ্ছিলো নোটন ছোটনের। লতিফ চাচার বাড়ি এখান থেকে অনেক দূর। পথে বিপদের অভাব হবে না। ওদের কাজ এখন শিহাব ভাইয়ের চিঠিটা স্বপন ভাইয়ের হাতে পৌঁছে দেয়া। ভুল করে চিঠিটা অন্য কারো হাতে পড়লে মহাবিপদ। সেদিন
রাতে ওদের তিনজনে বাড়ি পাঠানোর শত চেষ্টা বৃথা হয়েছিলো ওদের দৃঢ়তার কাছে। আজও তাই হলো। কাজটা দুই ভাই নিয়ে নিলো। যদিও খারাপ লাগছিলো সবার,তবে ওরাই জোর করলো। এগিয়ে চললো বুদ্ধিমানের মত নিজেদের
আবিষ্কার করা নতুন খেলার ছলে।
অবশেষেঃ চিঠি ঠিকই পৌছে ছিলো স্বপন ভাইয়ের কাছে। তারা সফল
হয়েছিলো তাদের পরিকল্পনায়। দেশ
মুক্তি পেয়েছিলো শত্রুদের হাত থেকে।
তবে অনেকের মত ফিরে আসেনি নোটন আর ছোটন। আজো ওদের মায়ের কানে বেজে ওঠে তার দুরন্ত ছেলেদের হৈচৈ। মায়ের হাত টেনে দুজনের মুঠো বাধা হাত বাড়িয়ে ধরা। চারিদিকের গোলাগুলির আওয়াজ ছাপিয়ে ওর মা স্পষ্ট শুনতে পেতো দুই ছেলের কন্ঠে-
“বলো তো মা তোমায় আমরা কি দিলাম?তোমায় আমার দেশ দিলাম।”