গল্প
নিয়তি
যাত্রাবাড়ি থেকে শ্যামলির উদ্দেশ্য রমিজ বাসে উঠল। বাসে উঠেই সিট খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ বাসের মধ্যের সারিতে বসে থাকা এক ভদ্রলোক ডাক দিলেন। এই যে বাবা! এদিকে আস! আমার পাশে বস! রমিজ কিছু চিন্তা না করেই ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসল। ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, আমার পাশে কোনো মহিলাকে বসাই না, এদের নাভি পাতলা, বাসে উঠলেই বমি করে বসে। রমিজ ভদ্রলোকের কথায় সায় দিয়ে মাথা ঝাকলো। রমিজ ভাবছে ভদ্রলোকের পাশে বসেই ভুল করেছে। এমনিতেই বেশি কথা পছন্দ না, তার উপরে আবার উপদেশমালা! তবে ভদ্রলোক যে উপদেশগুলি দিচ্ছেন তা, কাল্পনিক নয়, বাস্তবিক।
ভদ্রলোককে রমিজের কিছুটা পছন্দ হয়েছে। হয়তো বাস্তবিকতার কারণে। তবে কথা বলার তেমন আগ্রহ নেই। কি আর হবে পরিচয় হয়ে? ক্ষাণিকবাদে তো কেউ কাউকে চেনবো না। ভাগ্যেক্রমে যদি কখনো দেখা হয়, চিনতে তো পারবো না যে, আমরা একসাথে বাসে চড়েছি গল্প করেছি, নানান বিষয়ে আলোচনা করেছি, শুধু চিনাচেনা লাগবে বাস!
ভদ্রলোক রমিজকে জিজ্ঞাসা করলেনম, এই বাসটা কি কলেজ গেট যাবে? রমিজ বললো, জানি না। রমিজ হ্যাঁ ও বলতে পারতো। কেন জানি মুখ থেকে ‘না’ শব্দটাই বেরিয়ে আসল। মনে হয়, ইচ্ছে আর জবান দুটো মাঝে মধ্যে ঝগড়া করে। ইচ্ছের যদি হয় ‘হ্যাঁ’, জবান বলবে ‘না’। বাস! যত বিপদ নেমে আসে যতেœমাখা শরিরটার ওপর। তাদের মাঝ থেকে ভেসে আসা হ্যাঁ ও না শব্দটা, মানুষের জীবনকে কখনো তুচ্ছ কখনো বা অমূল্য করে তোলে।
ভদ্রলোক বাচালের মতো বকেই যাচ্ছেন, থামার কোন মতলব নেই। এখন আবার নিজেকে সৎকর্মপরায়ণ দাবি করে বসলেন। রমিজ একটু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি করেন? কিছু না। দশবছর আগে আমি চাকুরি করতাম, রিটায়ার্ড করেছি। এখন পেনশনের টাকা দিয়ে চলে। যখন চাকরি করতাম তখন আমার ভাই, বোন, শালা-শালি, সবাইকে দেখভাল করেছি, এখন আমি তাদের কেউ না।
ভদ্রলোকের কথা শুনে রমিজের অল্পমত মায়া লাগল। তিনার জীবনটা বিষাদমাখা মনে হল। কোথায় যাচ্ছেন?? নীলক্ষেত যাব, বইগুলো বিক্রি করতে। কিসের বই? আমার মেয়ের, এবার এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছে।
এবার রমিজের কথা বলার আগ্রহটা আরেকটু বেড়ে গেল। এখন ভদ্রলোককে অনক কিছু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা বইগুলো ত আশপাশের কোন বই দোকানেও বিক্রি করতে পারতেন? দরকার নেই! ওরা লোভী। বেশি লোভ করে। আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন? দু মেয়ে।
রমিজ একটু থেমে থেমে জিজ্ঞসা করল, কোন ছেলে নেই? ভদ্রলোক উত্তরটা একটু তিক্তভাবে দিলেন, দরকার নেই ছেলের, মেয়ে হলো ঘরের লক্ষি। মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে গিয়ে মারামারি করে আসে না, বাবার দুঃখ, দুর্দশা, অভাব না বুঝে হঠাৎ করে টাকা-পয়সা চায় না। তো ছেলের কি দরকার? মেয়েরাই ত লক্ষি। রমিজ, হুম, বলে চুপচাপ বসে রইল।
বাসের স্টার্ফ এসে ভাড়া চাইল। রমিজ ভদ্রলোকের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। চিন্তা করছে ভদ্রলোকের ভাড়াটা রমিজ দিয়ে দিবে, নাকি রমিজেরটাই তিনি দিয়ে দিবেন। কিন্তু ভদ্রলোক আগ বাড়াচ্ছেন না দেখে রমিজ নিজের ভাড়াটা দিয়ে দিল। খানিক পর ভদ্রলোক প্যন্টের পিছনে থাকা মানিব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে দিলেন, আর বাস স্টার্ফকে বললেন, ছেড়ে দাও! দশটাকাই রাখো।
বাস স্টার্ফ চুপচাপ চলে গেলেন। ভদ্রলোক রমিজের কানের পাশে মৃদু গলায় বললেন, আমার মেয়েকে কলেজে ভর্তি করাবো, অনেক টাকার প্রয়োজন, তাই নিজেকে একটু সংযত করছি। ভদ্রলোক কথাটা বলে অল্পমত হাসলেন। ভদ্রলোক বার টাকার ভাড়ায় দু টাকা সংযত করেছেন দেখে রমিজ বেশ অবাক হলো। বোধ হয় পৃথিবীর সব বাবারা এভাবেই সংযত করে থাকেন।
চলতে চলতে বাস শাহবাগে পৌঁছলো। ঢাকা শহরের ঐতিহ্য জ্যামে পড়ল বাস। পাশেই শিশুপার্ক। বাস থেকে শিশুপার্কে থাকা কতগুলো যুবক যুবতি দেখা যাচ্ছে। তারা আপন পরিক্রমায় ব্যস্ত। ভদ্রলোক রমিজকে বললেন, শুক্রবারে শিশুপার্ক খোলা রাখা দরকার ছিলো ছুটির দিন, সবাই একটু সময় পায়, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শিশুপাকে আসতে পারতো।
রমিজ বললো, না, আংকেল, শিশুপার্কে এখন আর শিশুরা আসে না। তো ভদ্রলোক জবাব দিলেন, তাও ঠিক। এখন তো সবাই কোটিপতি। বাড়িতেই শিশুপার্ক তৈরি করে রাখে। না, আঙ্কেল বিষয়টা তা নয়। শিশুরা আসে না কারণ তাদের বাবা-মা ভয় পায়। ভদ্রলোক বললেন, কেন? কারণ এখন আর শিশুপার্কে সুস্থ পরিবেশ নেই। শিশুপার্কে আসে যুবক-যুবতি শিশুরা। পার্কের দেয়ালগুলো এখন অন্ধকারে ঢাকা।
ভদ্রলোক শিশুপার্কের দিকে তাকিয়ে রমিজের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, আর বললেন, ঠিক বলেছো। রমিজ একটু মৃদু হাসলো। ভদ্রলোকের গন্তব্যস্থান চলে এলো। কলেজ গেট। মাঝে অনেক কথা হলো। ভদ্রলোকের প্রতি রমিজের একটু চিত্তচঞ্চল জন্মালো। যাবার বেলায় রমিজ জিজ্ঞেস করলো, আপনার বাসা কোথায়? ভদ্রলোক বললো, যাত্রাবাড়ি। নাও আমার নাম্বার। ফোন দিও। কথা হবে।
রমিজ লোকটার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভদ্রলোক ধীরে ধীরে বাস থেকে নেমে যাচ্ছেন। তার হাঁটা-চলার মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত মায়া আছে। রমিজ আবিষ্কার করল মায়া শব্দটা অদ্ভুত। কারো জন্যে সীমাবদ্ধ নেই। কখন কার জন্যে মায়া হয়, তা বোধ হয় স্বয়ং মায়া নামক অদ্ভুত শব্দটাও জানে না।
রমিজের মন খটখট করতে লাগলো। ভদ্রলোককে কী যেন একটা বলা হয়নি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়! কি বলা হয়নি? তা কিছুতেই ধরতে পারছে না। সময়গুলো কেন যেন দ্রুত চলে যাচ্ছে। বাস শ্যামলিতে দাঁড়ালো। রমিজের গন্তব্যস্থল এখানেই। এখানে নেমে দু এক মিনিট হাঁটলেই তার ভাইয়ের বাসা। দু এক মিনিট হাঁটার মধ্যেও ভদ্রলোক বারংবার মস্তিষ্কে আঘাত হানতে থাকে। ভদ্রলোককে কি বলা হয়নি, তা কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। আজকাল রমিজের মাথায় একটা কিছু ঢুকলে তা যেন কিছুতেই হটতে চায় না। পরদিন ঘুম থেকে উঠে টুথ ব্রাশ হাতে নিতেই মনে পড়লো, ভদ্রলোককে কিছু টাকা সাহায্যের কথাটা বলা হয়নি।
রমিজের একটা সমিতি আছে। দরিদ্রদের জন্যে খোলা। আজ পর্যন্ত চারজন মানুষকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। তাদের ‘ইচ্ছে’ নামক সমিতিটির ফান্ডে এখন ৭ হাজার টাকা আছে। রমিজ স্থির করলো, ভদ্রলোককে ছয় হাজার টাকা দিবে।
ব্যাগ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে ফোন দিতেই রমিজ আতকে উঠলো। রং নাম্বারে যায়নি তো। না, নাম্বার তো ঠিকই আছে। তাহলে মেয়ে কণ্ঠ শুনতে পেলো কেন? বেশ মিষ্টি কণ্ঠ।
কিছুক্ষণ ইতস্তত বোধ করে রমিজ আবার ফোন দিল। মেয়েটার কণ্ঠে জড়তা ভাব। তা খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ভদ্রলোকের কথা জানতে চাইতেই মেয়েটা কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনি কী রমিজ সাহেব? রমিজ বিস্ময়ে জবাব দিলো, জি, হ্যাঁ। আমার বাবা গতকাল হার্ট এ্যাটাক করেছে। তিনি আর নেই। আপনার জন্যে একটা চিঠি রেখে গেছেন।
রমিজ এক মুহূর্তের জন্যে থ হয়ে গেলো। মুখ থেকে আর কোন কথা বেরোইনি। রমিজ জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। পূবের আকাশে সূর্য উদিত হচ্ছে। সূর্যের ম্লান আভা রমিজের মুখে এসে পড়ছে। রমিজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সূর্যের দিকে। খানিক পর অনুভব করছে, তার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
লেখা – আমান উদ্দিন
দশম শ্রেণী
দারুন নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা