জুবায়ের খান
ক্লাস হচ্ছে কিন্তু তিতলুর মনোযোগ নেই । পড়ালেখায় সে বেশ পিছিয়ে গিয়েছে । সামনেই সাময়িক পরীক্ষা, কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নেই তিতলুর । রেহানা বেগম প্রায়ই ফোন দেন তিতলুকে । অনেক কথা হয় তাঁদের । তিতলু সারাদিন কি কি করেছে তার শর্ট ডিস্ক্রিপশন শুনতে হয় রেহানাকে । তিতলু যেমন টা ভেবেছিল মা’কে ছেড়ে থাকা অসম্ভব কিন্তু এখন আর ওর তা মনে হচ্ছে না । নতুন সব কিছুতে অভ্যাস করে নিয়েছে নিজেকে । রেজাউল ইসলাম মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে তিতলুকে জিজ্ঞাস করেন, তোর মা কি একেবারেই চলে গেছে রে ? তোকে কিছু বলেছে ?
তিতলু প্রতিবার একই উত্তর, কিছুদিনের জন্য গেছেন । চলে আসবেন ।
রেজাউল ইসলাম ব্যবসায় মনোযোগ দিতে পারছেন না । রেহানার সাথে দ্বন্দ্ব চরম পর্যায় গিয়েছিল । অশান্তি অস্থিরতায় ব্যবসায় মন দিতে পারেননি এতদিন । এখনও পারছেন না । কেমন যেন শূন্যতা তার মনে ভির করে আছে । তিতলুর জন্য তার মায়া হয় । মাঝে মাঝে একা একা বিরবির করে বলেন, একা একা পনেরো বছরের একটা ছেলে বাবা মায়ের অস্বস্তিকর জীবন দেখে হয়তো খুব কষ্টই পাচ্ছে । নিজেকে খুব অপরাধী মনে করেন তিনি । বিরবির করে নিজেকে বলেন, রেহানাকে কি আনতে যাওয়া উচিৎ ? নাহ যে নিজে গেছে নিজেই আসবে ।
মাঝে মাঝে এসব ভাবতে অস্থির হয়ে যান । চিৎকার দিয়ে তিতলুকে ডাকেন । তিতলু কে বসিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করে শোনান । তিতলু চুপচাপ বসে বিরক্তিকর চাহুনি দিয়ে বাবার কবিতা শোনেন ।
স্কুল ছুটির সময় রাকিবের সাথে অনেক কথা হয় তিতলুর । মাঝে মাঝে বাবা মায়ের ব্যাপারটা নিয়ে রাকিবের সাথে কথা বলে তিতলু । রাকিব তিতলুকে পরামর্শ দেয়, তিতলু মাথা ঝাকিয়ে তা করার সম্মতি জানায় । রাকিব একদিন পরামর্শ দিল-
শোন তিতলু ! তোর বাবা মায়ের মধ্যে দূরত্ব কমাতে হলে ধীরে ধীরে আগাতে হবে । তোর বাবা মায়ের বিয়ের ছবি তোর বাবার ঘরের আশেপাশে রাখতে পারিস এতে তোর বাবার মন নরম হতে পারে । মাকে ফোনে বাবা সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলতে পারিস । আর তোর বাবা বা মায়ের ডায়েরি থাকলে তা পড়ে দেখতে পারিস । ভালো আইডিয়া পাবি ।
রাকিবের কথাগুলো তিতলুর মাথায় গেথে গেছে । বাবা মায়ের বিয়ের ছবি বের করতে হবে ভাবতেই তিতলুর কেমন যেন লজ্জা লাগে । হঠাৎ বাবার বিছানার নিচে বাক্সে খুজে পাওয়া গেল বিয়ের ছবি । তিতলু কিছুক্ষন কৌতুহল নিয়ে ছবিগুলো দেখলো । হঠাৎ ডায়েরির কথা মাথায় আসে তার । কিন্তু পুরো ঘর জুড়েই ডায়েরি খুজে পায়না সে । তিতলুদের বাসার পিছনে একটা স্টোর রুম আছে । রেহানা বেগম ও রেজাউল ইসলাম কেউ রুমটি খুব দরকার না হলে খুলে না । তিতলু জীবনে কেবল দুবার দেখেছে বাবাকে রুমটি খুলতে । রুমটিতে নিরাপত্তার তেমন কোনো হাবভাব থাকেনা কেননা রুমটি তালাবিহীন বটে কিন্তু বড্ড নোংরা ।
তিতলু স্টোর রুমের দরজা খুলতেই ভ্যবসা এক গন্ধ বের হলো । মাথার উপর মাকড়সারা সংসার গড়েছে । অনেক্ষন খোজাখুজি করে তিতলু এক কাপড়ের ব্যাগ খুজে পেল । ব্যাগটি যথেষ্ট ভারি । ব্যাগে উকি দিয়ে তিতলু দেখতে পেল অনেককিছু । ব্যাগ নিয়ে তিতলু নিজের রুমে চলে আসলো । তিতলু চাইলেই ব্যাগ থেকে সবকিছু নামিয়ে দেখতে পারে কিন্তু সে দেখেনা । তার মাঝে অজানা এক ভয় কাজ করে সাথে উত্তেজনায় কেপে উঠে পুরো শরীর । ব্যাগে হাত দিয়ে প্রথমে তিতলু একটি ডায়েরি খুজে পায় । ডায়েরিটি পরীক্ষা করে দেখতে পায় , তাতে কিছু ফোন নাম্বার ছাড়া কিছুই নেই । তিতলু আবারো ব্যাগে হাত দিয়ে কতগুলো বাচ্চার রোমাল ও জামা বের করলো সাথে বের হলো ছিড়ে যাওয়া লাল টুকটুকে শাড়ি । এসব দেখে তিতলু খানিকটা হতাশ হলো । বিরক্ত হয়ে ব্যাগটি উল্টো করে ফেলে দিল । ব্যাগের ভিতর যা যা ছিল সব বের হয়ে আসলো সাথে একটি ডায়েরিও । ডায়েরিটি দেখে তিতলুর বুক ধকধক করতে থাকে । সাহস করে সে ডায়েরি টি খুলে । ডায়েরি খুলেই তিতলু একটি ছবি দেখতে পায় । ছবিটিতে মধ্যবয়সী এক মহিলা দেখতে পায় এবং মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে আছে এক কিশোরী । পাশেই বসে আছে এক লোক তার কোলে একটি শিশু । তিতলু বুঝতে পারলো এটি একটি পারিবারিক ছবি । শিশুটির চেহারার সাথে ও নিজের ছোট বেলার ছবির মিল খুজে পায় । নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে বাবার রুমে গিয়ে ঝুলে থাকা পারিবারিক ছবিটি দেখতে থাকে । তিতলুর কাছে সবকিছু অলটপালট লাগতে থাকে । সে আশ্চর্য হয়ে খুজে পাওয়া ছবিতে শিশুটির চেহারা ও তার ছোট বেলার চেহারার মিল দেখতে পায় । উত্তেজনায় তিতলু ডায়েরির পেইজ উল্টোতে থাকে । হঠাৎ করেই তার চোখ একটি পৃষ্ঠায় এসে থেমে যায় । পৃষ্ঠাটিতে তিতলু দেখতে পায় একটি দিনলিপি লেখা ।
চলবে….
অলংকরন-জুবায়ের খান খান