জুবায়ের খান
বেশ কিছুদিন হলো তিতলু স্কুলে যায়না । রাকিব সেদিন ফোন করে জানতে চাইলো স্কুলে না যাওয়ার কারণ কিন্তু তিতলুর কাছ থেকে সে তেমন কোনো পরিষ্কার উত্তর পেল না । তিতলুর এখন কিছুই ভালো লাগে না । স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ পায়না । বাসায় এখন থমথম অবস্থা । বাবা মা কেউই কথা বলে না । খাবার টেবিলে রেজাউল ইসলাম গল্প করতে ভালোবাসেন কিন্তু আজকাল কোনো কথাই তিনি বলেন না । চুপচাপ খেয়ে চলে যান । রাতে বাসায় ফিরেন দেরি করে । বাসার পরিবেশ ভয়াভহ হয়ে উঠেছে । প্রতিদিনের এমন অবস্থা দেখে হাপিয়ে উঠেছে তিতলু । তিতলুর ইচ্ছে করছে যেদিকে দু চোখ যায় সে দিকে চলে যেতে, খোলা মাঠে জোরে জোরে চিৎকার করতে । কিন্তু তা করা এখন সম্ভব না । তিতলু নিজের ঘরে এদিক সেদিক পাইচারি করতে থাকে ।
রেহানা বেগম স্যুটকেস গুছিয়ে তিতলুর কাছে বসে কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে বললেন,”তিতলু তুই এখন বড় হয়েছিল । যত্ন নিতে শিখেছিস । এখন তোকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই আমার । আমার ছেলে এখন নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারবে । তাইনা ?”
তিতলু মায়ের এসব কথা বলার কারণ বুঝতে পারছেনা কিন্তু অনুমান করতে পারছে কিছু একটা হতে চলেছে । স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তিতলু মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে । রেহানা বেগম ছেলের দিকে না তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বলতে লাগলেন, “আমার মনেহয় কিছুদিন বাহিরে ঘুরে আসা দরকার । ভেবেছি তোর নানুর বাসায় ঘুরে আসবো । কয়েকদিন থাকলে ভালো লাগবে । আর তোর বাবার কাছ থেকে এখন যত দূরে থাকবো ততই ভালো । এতে সে আমার অভাব বুঝতে পারবে আর দুজনই নিজেকে আলাদা করে সময় দিতে পারবো । তুই পারবিনা তোর বাবার সাথে এই কয়দিন থাকতে ?”
তিতলু বুঝতে পারলো বাবা মায়ের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেড়েছে । মা এখন একা থাকতে চাইছে । তিতলুর কাছে সবকিছু অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো । তিতলু একটু গম্ভির হয়ে উত্তর দিল, “তুমি আমাদের একা রেখে চলে যেতে চাইছো ?”
ছেলের এমন কথায় রেহানা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন । ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন তিনি কেবল অল্প কয়েকদিনের জন্য যাচ্ছেন, আবার ফিরে আসবেন ।
তিতলু মায়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । রেহানা বেগম ছেলের চোখে চোখ রেখে কিছু বলতে পারছেন না । রেহানা বেগম হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন । দুই হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,” তিতলু তুই আমার সোনার টুকরা ছেলে আমার মানিক আমার সাত রাজার ধন । তোকে ছেড়ে আমি কখনও চলে যেতে পারি বল ?”
“তাহলে এখন কেন যাচ্ছ মা ?”
“রেহানা বেগম কান্না থামিয়ে বলতে লাগলেন, তোর বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা দিন দিন খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে । এমন চলতে থাকলে সামনে হয়তো….
কিছুদিন যদি তোর বাবা কে সময় দেই তবে সে আমার প্রয়োজন অনুভব করবে । নিজের সব অভিমানগুলো ভুলতে পারবে । আমিও তাই । যখন সব ঠিক হবে আমি চলে আসবো ।”
তিতলু আরেকটু গম্ভির হয়ে বললো, “মা । আমি এখন আর ছোট খোকা নই । এসব ছেলে ভোলানো কথা আমায় বলো না । তোমাদের দ্বন্দ্ব কি আদৌ মিটবে ? আর যদি কখনও তোমাদের দূরত্ব না কমে তবেকি তুমি কখনও ফিরবে না ? বলো?”
রেহানা বেগম অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন । অনেক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, “তোর বাবা কে আমি খুব ভালোবাসি । আমি তাঁকে কখনও ছেড়ে চলে যেতে পারবো না । তবে তোর বাবার কথা বলতে পারছিনা । তুই তো দেখেছিস সে কত রাত করে বাসায় ফিরে । খাবার টেবিলে বসে কোনো কথাও বলে না । একই ঘরে থাকি কিন্তু তোর বাবা এমন ভাবে থাকে যেন আমি থেকেও নেই । আমাকে সে সহ্য করতে পারছে না । এতো অবজ্ঞা অবহেলা আমি আর নিতে পারছিনা । তোর বাবার মনে যদি আমার জন্য একটু ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা আবার এক হবো । আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । তুই আর আমার কষ্ট বাড়াস নে । হাসি মুখে আমায় বিদায় দে বাপ ।”
রেহানা বেগম চলে গেলেন । দরজায় দাড়িয়ে তিতলু মায়ের চলে যাওয়া দেখলো । তিতলুর আর কিছুই ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে মরে যেতে ।
অনেকদিন তিতলুর স্কুলে যাওয়া হয়নি । এখন মাও নেই । ঘরে এভাবে একা থাকা অসম্ভব । ঘরে দু জন কাজের লোক আছে কেবল । বাবা কখন আসে আর কখন চলে যায় তিতলু বুঝতে পারে না । তিতলু মনস্থির করলো যে এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না । স্কুলে গিয়ে রাকিব কে সবকিছু বলা দরকার । যদি ও কিছু করতে পারে ।
অনেকদিন পর তিতলুকে স্কুলে দেখে সবাই তাঁকে ঘিরে রাখলো । সবার মুখে কৌতুহলের ছাপ । সবার হাজারটা প্রশ্নের উত্তর তিতলুর দিতে ইচ্ছে করছে না । ক্লাসরুমে গিয়ে দেখতে পেলো রাকিব ব্যাঞ্চের এক কোণায় বসে কিছু একটা পড়ছে । তিতলু কাছে গিয়ে বললো, “কিরে কি পড়িস ?”
“হুহু ? উমমম শেষ যাত্রা !”
“স্কুলে না গল্পের বই আনা নিষেধ ?”
“ইইই আস্তে বল আস্তে । ক্যাপটেন জানলে সব শেষ !
আচ্ছা ঠিকাছে । আমাকে এতোদিন পর দেখে তুই অবাক হসনি ?”
“হয়েছি তো কিন্তু তুইই তো এসে প্রশ্ন ছুড়ে দিলি ।”
চলবে…