সামিরা শাইবা অথৈ
“মানুষের জীবন কি চক্রের মত? চক্রের কোন শুরু নেই, শেষ নেই। মানব জীবনও কি তাই? রহস্যময় চক্রের ভেতর এই জীবন ঘুরপাক খেতে থাকে? শুরু নেই, শেষ নেই। চক্র ঘুরছে”- এইভাবেই রহস্যের চক্রে তাঁর পাঠকদের আজীবন ঘুরিয়েছেন এমনি একজন রহস্যময় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর সম্পূর্ণ জীবনব্যাপী তিনি তাঁর পাঠকদের উপহার দিয়ে গেছেন শ্রেষ্ঠ সব গল্প, উপন্যাস। পছন্দের লেখক এর নাম এলে বেশিরভাগ পাঠকই চিন্তাভাবনা ছাড়া একটি নামই বলে দিতে পারবে ‘হুমায়ূন আহমেদ’। বইপ্রেমিদের মধ্যে অনেক কম পাঠকই খুঁজে পাওয়া যাবে যে কিনা জীবনে তাঁর একটি রচনাও কখনো পড়েনি। বাংলা সাহিত্যে সোনালি বর্ণে লিখিত লেখকদের মধ্যে তাঁর নাম উজ্জ্বলভাবেই ফুটে আছে।
কালজয়ী এই সাহিত্যিক এর জন্ম ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮, মোহনগঞ্জ নানাবাড়িতে; জেলা নেত্রকোনা। মা হলেন আয়েশা ফয়েজ, বাবা ফয়জুর রহমান। তিনি ছিলেন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন। হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে অধ্যয়ন এবং পরবর্তীতে একই বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস “নন্দিত নরকে” (১৯৭৩) দিয়ে সাহিত জগতে তিনি যাত্রা শুরু করেন, যা ছিল মূলত জয়যাত্রা। জীবন রহস্য, জীবনের সহজ-কঠিন চিত্র তুলে ধরা, বোহেমিয়ান জীবন, কল্পবিজ্ঞান, মধ্যবিত্ত মানুষের চিত্র থেকে শুরু করে এমন খুব কমই সামাজিক চিত্র আছে যা তাঁর লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে নি। লেখার মাধ্যমে পাঠককে ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যেতেন তিনি। যেই জগতে ছিল একধরনের নেশা। তাঁর বই পড়ে আসক্তি জন্মায় নি এমন খুব কম মানুষ এ আছে। তাঁর শিল্পকর্মের ভাণ্ডার খুবই বিশাল। উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র, গান লেখা, পরিচালক, নির্মাতা ইত্যাদি সকল স্থানেই তিনি দেখিয়েছেন সম পারদর্শিতা।
তাঁরই লেখা “এইসব দিনরাত্রি” টেলিভিশন নাটকের ধারা বদলে দেয়। “কোথাও কেউ নেই” এর মাধ্যমে তিনি ইতিহাস রচনা করেন। এই গল্পের চরিত্র বাকের ভাইকে বাঁচাতে রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত করা হয়। “শ্যামল ছায়া”, “ঘেটূপুত্র কমলা”, “আমার আছে জল”, “বহুব্রীহি”, “আগুনের পরশমণি”, “নয় নম্বর বিপদ সংকেত” ইত্যাদি বাংলার কাছে অমর হয়ে আছে। তাঁর নিজের চরিত্রই তাঁর রচিত হিমু এবং মিশির আলির মত রহস্যময়। “মাতাল হাওয়া”, “নীল অপরাজিতা”, “সাজঘর”, “অপেক্ষা”, “মেঘ বলেছে যাব যাব”, “বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল”, “প্রিয়তমেশু” ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। রহস্যময়ী এই সাহিত্যিক অতি তরুণ বয়সেই বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। একুশে পদক, বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। দেশে ও বিদেশে তিনি সমানভাবে সমাদৃত ও সম্মানিত। এই মহান সাহিত্যিক ১৯ জুলাই ২০১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা সাহিত্য তাকে এবং তাঁর শিল্পকর্মকে সমাদর করবে চিরকাল।