জুবায়ের খান
‘মা? ও মা। তোমার লেইগা একটা ভালা খবর নিয়া আইছি ।
মা কথা কও না কেন? তুমি জানো কি হইছে? আইজকা যা দেখলাম !! জব্বার রাজাকার রে আইজকা ছোডো নদীর পারে মইরা পইরা থাকতে দেখছি।
মা? আমি জানি তুমি খুব খুশি হইছো!’
রবিউল তার মা আফসানা বেগমকে কতক্ষন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কথাগুলো বললো । রবিউল জানে যে তার মা অর্ধপাগল , তবুও তার মনে হচ্ছে এই খুশির খবরটি মা কে না জানালে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তার অসমাপ্ত থেকে যাবে । কিছুক্ষন পর রবিউলের মনে হতে লাগলো যে মায়ের মত সেও ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু সে এখনি পাগল হতে চায়না , সে জানে খুব শিগ্রয়ই দেশ স্বাধীন হবে । সে সেই আনন্দেই পাগল হতে চায় । তাই সে মায়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে দৌড়ে আবার অজানা খোঁজে বেড়িয়ে পড়লো ।
আফসানা বেগম অর্ধ পোড়া ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বসে বসে বাড়ির পূর্বের বাঁশঝাঁরের দিকে নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে ।
আফসানা বেগম এমন ছিলেন না , তার ছিল এক সুন্দর জীবন । সাথে ছিল এক সুন্দর সংসার । যেখানে সর্বোক্ষন তাদের মায়া অভিমান , ছেলে মেয়ের হাসাহাসি কান্নাকাটি ও খুনশুটি বিরাজ করতো । সেই সংসারকে হঠাৎ করেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে একদল হিংস্র পশু ।
ঘটনাটি চার মাস আগের…
রতন মিয়া বাজার করে ঘরে ফিরেছে । স্ত্রীর চোখের দিকে আতঙ্কের দৃষ্টি দিয়ে বললো,
‘সর্বনাশ হইয়া গেছে আফসানা । ‘
‘কি ? কি হইছে ?’
‘সর্বনাশ হইছে । ‘
‘কি সর্বনাশ হইছে , সেইটা কইবা তো ?’
‘আইজ বাজারে মিলিটারি আইছিল । ছারখার কইরা দিছে সব । দোকানি অঞ্জন দাস রে সবার সামনে জবাই কইরা মারছে ।
চলো আমরাও পালাই যাই । আমগোরেও নাইলে মাইরা লাইবো ।’
‘গ্রাম ছাইড়া কই যাইবা ? আমগো মুসলমানগো ওরা মারবো না , চিন্তা কইরো না ।’
‘হুনলাম সব নাকি গ্রাম ছাইড়া পালাইতাছে, মোরশেদাগো পরিবারো…….’
‘আহা ! এতো চিন্তা করো কেন ? কিচ্ছু হইবো না । কি রান্না করছো সেইটা কও , খিদা লাগছে জোরে ।’
চিন্তামগ্ন মন নিয়ে আফসানা বেগম বললেন,
‘আজ মাসকলাই ডাইল , বেগুন ভাজি রাধছি । পেট ভইরা খাও । আমি রুনারে ডাইকা আনি ।
কিরে রুনা ? কতক্ষন লাগায় চুল আছরাবি ?? তোর বাবজান আইছে , খাইতে আয় ।’
‘আইতেছি মা ।’
‘আর হুন রবি কই ?’
‘জানিনা মা , তোমার পোলাতো জানই , সারাদিন ঘুইরা বেড়ায় ।’
‘সময়কাল ভালানা । পোলাপান যদি একটু বুঝতো !’
হঠাৎ এক মধ্যরাতে আফসানা বেগমের আচমকা ঘুম ভাঙলো । রতন মিয়াকে ডাকতে শুরু করলেন ।
‘কিগো ? হুনতেছো ?’
রতন মিয়া চোখ কুচকে জবাব দিলেন ।
‘কি ?’
‘ঐ দেহো গোলাগোলির শব্দ অইতাছে । সব শেষ কইরা লাইতাছে ।’
‘তুমি ঘুমাও তো । কিচ্ছু হইবো না । আমি আছি ।’
আফসানা বেগম শুয়ে পড়লেন । ঠিক এক ঘন্টা পর দরজায় ঠকঠক । আফসানা বেগম আবার রতন মিয়াকে ডাকলেন ।
‘কি হইছে আবার ?’
দেহো না কেডা জানি ঠকাইতাছে ।
‘দাঁড়াও দেখতাছি ।
.
কে ?’
দরজার ঐপাশ থেকে কোনো শব্দ আসলো না ।
‘কে ? কথা কয়না কে?’
আফসানা বেগম আতঙ্কে মুখ ঢেকে নিলেন । অন্যরুমে রুনা তখনও ঘুমে ।
সাহস করে রতন মিয়া দরজা খুললেন । দেখলেন রবিউল দরজার বাহিরে ।
‘তুই বাইরে কেন রবিউল?’
রবিউল কোনো কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেল ।
‘কিরে কথা কস না কেন ?’
‘বাজান, আগে দরজা বন্ধ কর , কইতাছি।’
রতন মিয়া দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন । ‘তোর এতো বড় সাহস তুই এতো গন্ডগলের রাতে বাহিরে…… ‘
রতন মিয়াকে থামিয়ে রবিউল বলে উঠলো,
‘বাজান জব্বার চাচারে নিয়া মিলিটারিরা রাজুগো ঘরে ঢুকছিল । ওর বাপরে মাইরা লাইছে । রাজুরে আমি জঙ্গলে পালায় যাইতে দেখছি।’
‘তুই ঐখানে কেন গেছস? মায়ের কথা কবে হুনবি?’
আম্মা….
রবিউল কে থামিয়ে রতন মিয়া আফসানা বেগমের দিকে চেয়ে বললেন, ‘সবই তোমার লেইগা, পোলাডারে আরো লায় দাও?
এহন ঘুমাইতে যাও সবাই । আর রবিউল তোরে যদি বাইরে আর যাইতে দেখছি , ঠ্যাং ভাঙমু।’
আফসানা বেগমের চোখে ঘুম নেই । একঘন্টা চলে গেল, এই আতঙ্কে তার আর ঘুম হচ্ছে না । সে ভাবছে সকালই রতন মিয়া কে বলবে যে যদি সে তাদের নিয়ে কাল গ্রাম ছেড়ে না পালিয়ে যায় তাহলে সে তার সন্তান নিয়া রবিউলের নানা বাড়ি চলে যাবে । ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে দরজায় আবার ঠক ঠক ।
আফসানা বেগম আতকে উঠলেন ।
ঐ হুনতেছো ?
কি হইলো আবার ?
দরজাডা ঠকাইতাছে ।
তোমার পোলায় আবার বাইরে গেছে । আমি আর পারুম না , দরজা খুইলা ভিতরে ঢুকাও আর পাছায় কয়ডা বাড়ি দিও নাইলে সিদা হইবো না ।
আফসানা বেগম কিছু বললেন না । দরজা খুলবেন কিনা খুলবেন না এই ভাবতে ভাবতে দরজায় হাত দিলেন হঠাৎ এক ধাক্কায় দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলো সাত আট জন পাকিস্তানি সেনা । আফসানা বেগম মাটিতে পড়ে গেলেন । রতন মিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো, আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘কি হইছে রবিউলের মা? কিগো? ‘
অন্যরুম থেকে রবিউল বের হয়ে আসলো । মা কে পড়ে থাকতে দেখে মায়ের কাছে এসে দেখলো কয়েকজন বড় বড় মানুষ খাড়া হয়ে দাড়িয়ে আছে।
‘এ ব্যাটা এধার আউ।’
রবিউল বুঝলো না লোকটা কি বললো, কিন্তু হাতের ইশারায় বুঝতে পেরলো তাকে তার কাছে আসতে বলছে । হুট করে ঘরে ঢুকলেন জব্বার আলি ।
রবিউল কাছে গেলে লোকটি বললো,
‘তোমহারা বাপ কিদার হ্যা।’
জব্বার আলি লোকটির দিকে চেয়ে বললো,
‘স্যার আপ পেরেশান মাত হনা, ম্যা ঢুনতাহু উস সালা কো।’
অন্যরুম থেকে দুই সৈন্য রতন মিয়া কে ধরে নিয়ে এসে বললেন,
‘স্যার মিলগায়া।’
‘গুড জব।’
লোকটি ঘর থেকে বের হলেন সাথে বাকি সৈন্যগুলোও । রতন মিয়া কে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আরো দুই সৈন্য । বাবাকে নিয়ে যেতে দেখে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা রুনা বের হয়ে চিৎকার করে বললো,
‘বাজানরে কই লইয়া জান ? কই লইয়া জান বাজানরে।’
চিৎকার শুনে সৈন্যগুলো আবার পিছনে তাকালো।
জব্বার আলি বললেন, ‘স্যার ইস লারকি…… ‘
‘ইটস ওকে, ইসকো বাদমে দেখলুংগা। ‘
আফসানা বেগম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন । কিছুক্ষন পর তার জ্ঞান ফিরলো ।
‘তোর বাজান কই রুনা ? তোর বাজান কই?’
মা, বাজানরে নিয়া গেছে ।
আফসানা বেগম চুপ করে থাকলেন । রুনা বললো,
‘মা চলো আমরা এহেন্তে পালায় যাই’
আফসানা বেগম এবারো কিছু বললেন না ।
‘মা চলো না পালায় যাই। নানা বাড়ি যাই। এহানে থাকলে ওরা মাইরা ফেলাইবো।’
ওরা তোর বাজানরে চাইছিল, তারে নিয়া গেছে । ‘এক মাস হইয়া গেছে , এহন আর আইবোনা হেরা । তুই দেখ রবিউল কই।’
রবিউল দৌড়ে আসছে চিৎকার করতে করতে ।
‘আম্মা ! আম্মা ! আইতাছে!’
‘পালা রবি পালা। তোর বইন কই? ‘
‘আমি জানিনা মা। রুনা আপা কই?’
‘তোর খোজে বাইর হইছিল । জলদি ওরে লইয়ায় ।’
‘আমি দেখতাছি ।’
রবিউল বোনের খোজে বের হলো । না পেয়ে আবার ঘরে ফিরে দেখলো রুনাকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে । ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা । আফসানা বেগম মারাত্মকভাবে আহত হয়ে চিৎকার করছেন । রবিউল দৌড়ে গেলো রুনার দিকে কিন্তু ওর পক্ষে সম্ভব হলো না বোন কে বাঁচানোর ।
.
‘আফজাল ভাই কই যাইতেছো ?’
‘কিরে রবি তুই জানছ না ? আমাগো দেশ স্বাধীন হইছে । হোকলে বিজয় মিছিল করতে যাইতাছে, যাবিনা তুই ?’
রবিউল মাথা নেড়ে আফজালের সাথে চলতে শুরু করলো আর বলতে লাগলো ‘জয় বাংলা !’
জুবায়ের খান
একাদশ শ্রেনী, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ ।