Sunday, April 27, 2025
28 C
Dhaka

শীতের দিনগুলোতে প্রেম

-যিয়াদ বিন সাঈদ

শহুরে এ জীবনে আমি কখনওই শীতকে ঠাহর করতে পারিনা। অনুভবে আনতে পারিনা আমার শীতের সকালগুলো মূলত কেমন। অথবা কনকনে শীতের কোনো রাতে কীভাবে আয়েশ করে কম্বল মুড়ে আরাম করে ঘুমানো যায়; তাও ভাবতে পারিনা। দিনেরাতে ফ্যান চলে হুরহুর করে। পুরোদমে। মাঝে একবার কম্বলের নিচে একটু আয়েশ করে ঘুমোতে গেলে, দেখি আমি ঘেমে যাচ্ছি। আমার মনে হয় ক্ষুদ্রকালীন এ জীবনে আমি আমার সঙ্গে প্রচণ্ড অত্যাচার করে ফেলেছি।কিন্তু অনেক বিরক্তির পরও আমার জীবনে আছে খানিক শীতলতা। নির্মমতার ভেতর দিয়েই কিছুটা প্রশান্তচিত্ত। বইপত্তরে পড়েই কি কেবল আমি শীতকে চিনেছি? অথবা লীলেনের সংবেদনে? উঁহু। পঞ্চমাত্রারএ ঋতু নিয়ে আমারও তো গল্প আছে। যে গল্পটা স্বস্তির। আর একটু আরামেরআমার সমস্ত জুড়ে এমনি একবার শীততাপ বইয়ে গিয়েছিলো অনেক আগে; যেমনটি শামসুল হকের কবিতার পাতায় আমার গোচর হয়। আজকে হয়তো সে গল্প করতেই বসেছি শুক্রবারের এমন ঝকঝকে সকালে। এমন সকালে আমি সে গল্প করছি যেখানে জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যায় মাঝরাতে মধ্যযুগীয় প্রবল বর্বরতার নির্মাতা এক মহান স্বামী প্রবল প্রতাপে নিমের মাজন দিয়ে মাজছেন দাঁত।গেলো বছরের শীতের কথা। আমার সঙ্গে তখন মালিশার খুব ভাব। একদম উজাড় করা হৃদয়ে আমাদের সেসব দিন গুজরানো হতো। আমরা একে অপরকে নিজের চেয়েও বেশী পছন্দ করতে শুরু করলাম। মালিশা মফঃস্বলের মেয়ে ছিলো। বাবা সরকারী চাকুরীজীবি। সমাজকল্যাণ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মেয়ের ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন। চশমাপরা এ ভদ্রলোক মেয়েকে রাতে মোবাইল হাতে নিতে দিতেন না। এদিকে আমার প্রেমেজর্জর হৃদয় সারাদিন ক্লাস শেষে রাতে মালিশার সঙ্গে একটু কথা না বলতে পেরে দিন দিন কেমন মরে যেতে লাগলো। আমার এখন বলার বিষয় মূলত এগুলো না। আমি শীতকে স্মরণ করতে গিয়ে এই গল্প বলা শুরু করলাম। বলার কথায় ফিরে যাই।সে বারের শীতে মালিশা আমাকে খুব অনুনয় করে বললো আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। পারত পক্ষে এটা আমার জন্যে অসাধ্যই ছিলো বলা চলে। সেই সুদূর টাঙ্গাইল। কিছু চিনিনা জানিনা। এদিকে আব্বু আম্মুকে কী বলবো? অনেক ঝক্কিঝামেলার পর আমার মনকে স্থির করলাম আমি মালিশার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। মালিশা টাঙ্গাইল সদরে থাকে। কিন্তু ওদের গ্রামের বাড়ি যেটা, সেটা একটু ভিতরে। মফস্বল ছাপিয়ে ভূয়াপুর নামেরযে গ্রামটি আছে ওখানেই ওদের বাপ দাদাদের ভিটেমাটি। আমার চিন্তার উদ্রেক হলো। আমি টাঙ্গাইল যেয়ে কোথায় থাকবো? নিশ্চয় ওদের বাসা আমার জন্যে অনিরাপদ। ওর বাবা মালিশাকে সহ আমাকে জ্যান্ত মারবে। কিন্তু মালিশা বুদ্ধিমান। সে বললো সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে যিয়াদ। তুমি আসো।ঢাকা থেকে নিরালা ট্রান্সপোর্ট নামের মধ্যবিত্ত ধরণের বাসটিতে চেপে বসে আমি টাঙ্গাইলের দিকে রওনা করলাম। আমার পরনে কালো রঙ্গের মাখন জর্জেটের একটি পাঞ্জাবী। উতলা হৃদয়। প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করবার অনুভূতিটা দুর্দান্ত ছিলো। পাশাপাশি একটু ভয়েরও ছিলো।বাসে ঘুমিয়ে পড়লাম। আরামের ঘুম। শহর ছেড়ে যতই গ্রামীণ পরিবেশে ঢুকছি, বাতাসের শীতলতা ততই ভয়ার্ত। সকাল দশটার হালকা রৌদ্রের ভেতরেও কেমন শীত শীত লাগছে।সুপারভাইজারের ডাকে ঘুম ভাঙলো। আমরা টাঙ্গাইল চলে এসেছি। আমি বাস থেকে না নেমে মালিশাকে ফোন করলাম। বিজি পাওয়া যাচ্ছে। দশ পনেরো মিনিটের ভেতরেই মালিশা আমার কল ব্যাক করলো। বাসের জানালা দিয়ে অদূরেই দেখলাম একটি মেয়ে তৃষ্ণার্ত চোখে এদিকওদিক তাকাচ্ছে, এবং হয়তোবা প্রথম প্রেমের প্রেমিক কে দেখবার জন্যে ওর প্রতীক্ষিত হৃদয় আনচান করছে শুধু। ফোনে আমি শুধু বললাম, মালিশা আমি আসছি।তাড়াহুড়োর ভঙ্গিতে মালিশা আমার হাত চেপে দ্রুত গতিতে একটা কালো রঙের প্রাইভেট কারের ভেতর ঠেলে দিলো। আমি বোকা ধরণের ছেলের মত গাড়িতে উঠে চুপ মেরে বসে পড়লাম। কেমন অসহায় বোধ হচ্ছে আমার। মালিশা পাঁচমিনিট পর এক প্যাকেট কেক আর দুটো কোকের বোতল নিয়ে ফিরে এলো। এখন আমার বোধ হলো, মধুচন্দ্রিমায় এমন ঘরজামাই সেজেই হয়তোবা কাটাতে হবে আমার জীবন।যিয়াদ, ফেসবুকে তোমাকে দেখতে যেমন, এর চাইতে তুমি বেশ ভিন্ন রকম। মালিশা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আমার সঙ্গে কথা বলছে। ইতিমধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি জানিনা।মালিশার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে আমার আধঘণ্টার মত লাগলো। এরপর আমি একটু স্বস্তি পেলাম বোধহয়। এবং জানতে পারলাম আমরা মালিশার গ্রামের বাড়ি ভূয়াপুর যাচ্ছি। সেখানে কেও থাকেনা। মালিশা একদিনেরজন্যে গ্রামের বাড়ি ঘুরবার ছুটি নিয়েছে বাসা থেকে। ওর বাবা মেয়ের প্রতি এতটাই সচেতন যে তিনি তার মধ্যবিত্ত আয়ে কেনা কালো রঙের এ গাড়িটি মেয়ের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। আমি এখন মালিশার দুঃসাহস নিয়ে বারেবার চমকে যাচ্ছি। আর ড্রাইভার? আমাদের ব্যাপারটা ওর বাবার কাছে না হয় অজানাই থাকলো। যদি এ ড্রাইভার বলে দেয়! হাস্যত মুখে মালিশা বললো, কাদের ভাই আমার খুব প্রিয়জন। তাকে অন্যকিছু ভেবোনা যিয়াদ।আমরা ভূয়াপুর চলে এসেছি। তখন মধ্যদুপুর। আমার খুব খিধে। যখন আমার এ প্রচণ্ড খিদে লাগবার কথা মালিশা কে বলতে পারলাম, আমার মনে হলো; হ্যাঁ, আমি আমার প্রেমিকার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকই আছি। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর পায়ে হাঁটতে হবে। পথ খুব সুবিধের না। রোদওঠা দুপুরবেলা অসুবিধাজনক পথে আমার হাঁটতে ভালো লাগলো। শীত নিয়ে তো মূলত কথা। শীতের দুপুরে ছেলেপুলেদের উঠোনে বসে থাকতে দেখা গেলো। মায়েরা শাড়ি ছড়িয়ে দিয়ে রউদ পোহাচ্ছে, এ দৃশ্যটিও চমৎকার।লাল ইটের একটা বাড়ি। সামনেপিছনে ঝোপঝাড় আছে। চারোপাশে টিন দিয়ে একটা সুন্দর এবং একাকী থাকবার মত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ছোট্ট একটা উঠোন। এর এক কোনে আছে একটি বোগেনভিলাস। যেটা ঘরের চাল বেয়ে এদিকওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরটিকে আবৃত করে রেখেছে প্রাকৃতিক বলয়ে। এখানে সবচাইতে অবাক হবার মত যে বিষয়টি, এত সুন্দর একটি বাড়িতে একজনকেয়ারটেকার ধরণের লোক ব্যতীত আর কেউই থাকেনা। নীরব। নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো সাড়া নেই।কেয়ারটেকার আব্দুল জলিল আমাদের দেখে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এলেন। এ মানুষটি মালিশাকে আম্মা আম্মা বলে ডাকছেন। এবং যতরকমের শ্রদ্ধাবোধ দেখাচ্ছেন, সবটুকুই তার মালিশাকে নিয়ে। আমি যে ঢাকা থেকে আহূত একজন গেস্ট, এ নিয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একজন ত্রিশোর্ধ্ব আব্দুল জলিলের কাছ থেকে এমন অবাক করা সম্মোহন দেখে মালিশা আমার দিকে টুক করে চোখ টিপে বলতে চাইলো ইশারায়, সবে তো মাত্র শুরু। আমি কৃত্রিম হাসি হাসতে চাইলাম।মালিশাদের এমন অদ্ভুত বাড়িটির ভেতর ঢুকে আমি মোটামুটি ভিড়মি খেলাম। চকচকে মোজাইক এবং ঘরের পুরো দিকে আশ্চর্য সব কারুকার্য। দেয়ালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশাল একটি চিত্র। অন্যদিকে দেখা গেলো একটি বালা খচিত হাতের অবর্ণনীয় একটি ছবি।আমি ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি টাওয়াল হাতে মালিশা দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়। আমার হৃদয় টনটন করে উঠলো ভালোবাসায়।খাবার টেবিলে আমি এবং মালিশা বসেছি। আব্দুল জলিল ভাই দাঁড়িয়ে আছেনপাশে। বেড়ে বেড়ে দিচ্ছেন। মালিশার সামনে আমি সমস্ত লজ্জা টজ্জা ভেঙে আরাম করে খেতে পারছিনা, এ ব্যাপার টি হয়তো মালিশা টের পেয়ে গেছে। সে একটুখানি খেয়ে ভেতরে চলে গেলো। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম আরও। টাকি মাছের ভর্তা আর ধোয়া ওঠা গরম ভাতের মত খাবার ছেড়ে আমার একটুও ইচ্ছে করছিলোনা যদিও, তবুও অনাগত লজ্জার কথা ভেবে আমি হুরহুর করে উঠে গেলাম খাবার টেবিল থেকে।আমাকে যে রুমটি দেয়া হয়েছে সেখান থেকে স্পষ্ট একটি পুকুর দেখা যায়। পুকুর না এটা। কী যেন বলে! মানে খালবিল টাইপের একটা কিছু। কিন্তু পানি খুব কম। দেখে চোখে প্রশান্তি আসেনা। বিকালবেলা আমি আরমালিশা বের হয়ে গেলাম গ্রাম দেখতে। ঠাণ্ডাভাব পুরোপুরিই আছে। মালিশা একটি লং জ্যাকেট পরেছে। ক্যাপের চারিদিকে সিংহের লোম, আর মাঝখানে দেখলেই মায়া লেগে যাবার মত একটি চেহারা। আমি এবং মালিশা হাত ধরে আছি। আমরা হাঁটছি।মালিশার পুরো চেহারা জুড়ে কেমন শহুরে শহুরে ভাব। অথচ সে আমাকে এমন করে গ্রামটাকে ঘুরে ফিরে দেখাতে শুরু করলো, মনে হয় যেন এখানেই তার স্থায়ী আবাস। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম যমুনা নদীর কাছে। একদম কাছে। স্থানীয়দের ভাষায় ‘কালারোড’ নামে যে সড়কটি এর পাশ দিয়ে চলে গেছে, সেখানে আমরা ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। একটু ঘাস ঘাস আছে। শিশির পড়তে শুরু করেছে। এক্ষুনি হয়তো মাগরিবের আজান দিবে। যমুনার তীরে বসে থেকে আমার আর একটি বারের জন্যে ফিরে আসতে মনে চাইলোনা। মালিশা ক্লান্ত হয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে যখন, আমি ভাবলাম, মানুষের ক্ষুদ্রতম এ জীবনে এর চাইতে আনন্দ আর কোথায় আছে? সূর্য ডুবে যাচ্ছে। শীত বাড়ছে ক্রমাগত। একটু পরই শরীরেরগাঁট সব লেগে যাবে। মালিশাকে বললাম, মালিশা বাড়ি ফিরবেনা? কোনো সাড়া পাওয়া গেলোনা। তার দু হাতে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তখন আর জাগাতে চাইলাম না।কিন্তু সন্ধ্যা যখন পুরোপুরি নেমে গেছে, তখন আব্দুল জলিল ভাইয়ের কথা মনে হলো। আমাদেরকে আকাশ কালো হবার আগেই তিনি ফিরতে বলেছিলেন। অথচ এখন চারিদিকে পুরোপুরি আধার। কুয়াশা নেমে গেছে। আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও মালিশাকে ডেকে তুললাম। কিন্তু বারেবারেই মনে হচ্ছিলো, সে ঘুমাক। অনন্তকাল এভাবে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতেই থাকুক। এতো সুখের সৃষ্টি আমি আর কবে বা কোত্থেকেই করবো? ঘরে ফিরে এসে দেখি হুলুস্থুল কান্ড। আব্দুল জলিলকে মালিশার বাবা খুব বকেছেন, মেয়েকে এভাবে ছেড়ে দিয়েছেন বলে। মালিশা ওর বাবাকে ফোন দিয়ে স্বস্তিপাঠ করালেন, এবং কিছু বকাঝকাও হয়তো খেলো সে। কিছুটা মনখারাপ এবং হাসির ছলে কিছুটা কৃত্রিমতার ভেতর দিয়ে আমরা রাতের খাবার টেবিলে বসলাম। এ বেলায় আমরা খেলাম নদীর মাছ, নাম জানিনা । জানতে ইচ্ছে করেনি। আর বেগুনভাজা ছিলো। আমার এটা পছন্দের না। মালিশাদের এ বাড়িটিতে অনেকগুলো ঘর আছে। তবে আমাকে যে ঘরটিতে থাকতেদেয়া হয়েছে সেটা সবচাইতে সুন্দর। এখান থেকে জ্যোৎস্না দেখা যায়। জ্যোৎস্নার আলোতে দেখা যায় বিলের পানি থৈথৈ করছে। মালিশা কেমন কামনার্ত ভঙ্গিতে বললো আমাকে, রাতে তোমার ঘরে থাকলে তোমার কোনো অসুবিধা আছে যিয়াদ? আমি দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর করলাম, না। বরঞ্চ ভালোই হবে। আমাদের প্রথম সাক্ষাতে এমন একটি রাত আমরা একে অপরকে অন্য ঘরে রেখে আরামের ঘুম ঘুমাতে পারবোনা, এটা নিশ্চিত। তখন বোধহয় রাত নয়টা। পুরো গ্রামে কেউ জেগে আছে বলে মনে হচ্ছেনা। আমরা চুপিচুপি প্ল্যান করলাম, আব্দুল জলিল ভাই ঘুমাতে গেলে আমরা বের হয়ে যাবো ঘর থেকে। গ্রামের রাত আমাদের, অন্তত আমার কাছে অনেকাংশে কৌতূহলপূর্ণ। গল্প উপন্যাসে গ্রামের ছিমছাম এ পরিবেশের বর্ণনা পেলেও কখনো স্বচক্ষে এসব দেখা হয়নি। আর হবে কিনা জানিও না। মালিশা কে এখন দেখে মনে হলো সে এমন একটি পরিকল্পনার কথা ভেবে খুব আনন্দ পাচ্ছে। কিন্তু কী হলো শেষমেশ! আব্দুল জলিল ভাই দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলো, আম্মা! রাইতে কুনু রকম দরকার পড়লেই আমারে ডাইক্কেন। আমি হারা রাইত জাগনা তাহামনে। সাহেব আদেশ করছেন।আব্দুল জলিলের এমন কথা শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো পুরোপুরি। এবার অন্য কোনো কাজ করে রাতটা কাটাতে হবে। ম্যুভি দেখা যায়? না না, এরচাইতে মজার হবে আমরা গল্প করি। এত কিছু ভাবতে ভাবতে আমার অনুভব হলো ঘুমে আমার চোখ লেগে আসছে। মালিশা হয়তো টের পেয়ে গেছে। সে বললো, দাও বিলি কেটে দিই। আমি মালিশার উরুতে শুয়ে পড়লাম। গোল্ডেন বিয়ারের তকতকে কম্বল টি আমার সারা গায়ে জড়িয়ে দিলো মালিশা। তার হাতদুটোর আলতো স্পর্শ আমাকে বারবার বলছিলো যেন, যিয়াদ ঘুমিয়ে পড়িসনা। এ সুখ আর পাবি কোথায় তুই? শীতের সকালগুলো মূলত কেমন হয় গ্রামে গঞ্জে! আমি আর মালিশা হালকা নাশতা করে বেরিয়ে গেলাম শীতের এ সুন্দর ঝকঝকে সকালে। প্রচণ্ড কুয়াশা পড়েছে। হাড় কনকনে শীতে জবুথবু একটি গ্রামের ভোর দেখতে আমারপ্রচণ্ড ইচ্ছে ছিলো। এগুলো দেখে আমার মন ক্রমাগত ঔৎসুক হয়ে পড়ছিলোকেবল। কুয়াশা ঢাকা কিষান বাড়ির উঠোনের একপ্রান্তে দেখা যাচ্ছে গনগনে জ্বলন্ত উনুন। সে আগুনের আঁচে উনুনের ধার ঘেষে বসে আছে বাড়ির ছেলেবুড়ো সকলে। হাসিখুশী কিষাণী বউটির সুনিপুণ পটুতায় ঢাকনা ঢাকা হাড়ির ওপরে, একরতি কাপড়ের ভাজে ভাজে আতপচালের গুড়ো ঢাকা। নতুন খেজুর গুড় আর নারকেল কোরা দেয়া ছোট ছোট বাটি। আমার আর মালিশার এ সময়ে প্রচণ্ড পিঠে খেতে ইচ্ছে হলো। ভাপা পিঠা। এ ছবিটি পরম মমতার। স্নেহ আর ভালোবাসার। এবং পারিবারিক অটুট বাঁধনের এক চিরায়ত শীতকালীন ছবি। আমি আর মালিশা আরও কাছাকাছি চলে এলাম। আমার চাদরের ভেতর মালিশার শীতে বরফ হয়ে যাওয়া হাতটা বুকের কাছে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলাম।আরো একটু দূরে টি রোড নামের যে মোড়টি আছে, এখানে দেখা গেলো কয়েকটি টঙ দোকান। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকেদের জটলা। সবার গায়ের সাধ্যমত শীতের চাদর। কিংবা ছেঁড়াখোঁড়া কাঁথাখানি। গল্পে গল্পে এরা একের পর এক চায়ের কাপ শেষ করছে। জমে উঠছে শীতের এ সুন্দর সকালে তাদের আড্ডা। শীত এবং প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত শেষে আমার যখন ঢাকা চলে আসবার সময় হলো প্রচণ্ড দুঃখ এবং মন খারাপেরা আমাকে জেঁকে ধরলো। মালিশার সঙ্গে গ্রাম থেকে বাসস্ট্যান্ডের আসার পথে আমরা সবটা সময় চুপ রইলাম। কোনো কথা মুখ থেকে বেরুচ্ছেনা। শেষমেষ মালিশা যখন আমাকে চুমু খেলো, দেখি ওর চোখে জল চলে এসেছে। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি নিরালা ট্রান্সপোর্ট এ বসে আছি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মালিশাকে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে চাইলাম। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো। ভেতরে বাজতে থাকলো কেবল একটি প্রশ্ন, মালিশা আমি তোমাকে এতোটা ভালোবেসে ফেলেছি কেনো?

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img