Sunday, April 27, 2025
28 C
Dhaka

যুদ্ধ আজও শেষ হয় নি

দেওয়ান তানভির আহমেদ সৃজন

১. “ঠক ঠক ঠক! ঠক ঠক ঠক!!” পর পর বেশ কয়েকবার সজোরে আঘাত পড়ল দরজায়। ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকালেন জোহরা বেগম; মনে মনে ভাবলেন, এত রাতে কে এল আবার? কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”কে?” “আমি খালাম্মা, সাজ্জাদ।” চমকে উঠলেন জোহরা বেগম, ছুটে গেলেন দরজার কাছে! দরজা খুলে দেখলেন বাইরে দাড়িয়ে আছে ১৬ বছরের কিশোর সাজ্জাদ, তার চুল উষ্কো খুশকো, সেই চুল ঘাড় বেয়ে নেমে এসেছে, চোখ লাল, আর মুখ শুকনো।

“এসো! ভেতরে এসো!” বললেন জোহরা বেগম। ঘরে ঢুকলো সাজ্জাদ, জোহরা বেগম তাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললে সে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সাজ্জাদ শুকনো কণ্ঠে বললো, “পা-পানি খাব।” জোহরা বেগম তার মেয়েকে ডাকলেন,”জ্যোতি। একটু আয় তো এদিকে।” ভেতরের ঘরের দরজা একটু ফাক করে উকি দিল জ্যোতি, “কী মা?” “এক গ্লাস পানি নিয়ে আয় তো মা।” “আচ্ছা।” রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেল জ্যোতি। জোহরা বেগম তাকালেন সাজ্জাদের দিকে, সে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ এই পাড়ারই ছেলে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাতের অন্ধকারে নিজের ঘর থেকে হঠাত্ করেই লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল সে। কারোই বুঝতে বাকি ছিল না, সাজ্জাদ মুক্তিবাহিনীতে গেছে। সাজ্জাদের বড় চাচা, শান্তি কমিটির মেম্বার, সে তো রেগেমেগে নেই! আজ প্রায় তিন মাস পর সাজ্জাদকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স বুঝি এই তিন মাসে ত্রিশ বছর বেড়ে গেছে। জ্যোতি এসে সাজ্জাদের সামনে পানির গ্লাসটা রাখলো, সাজ্জাদ গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে পানিটুকু খেয়ে নিলো।

“তারপর?” জিজ্ঞেস করলেন জোহরা বেগম,”তোমার এই অবস্থা কীভাবে?” “আমি ধরা পড়ছিলাম।” বলল সাজ্জাদ। চোখ বড় বড় করে বললেন জোহরা বেগম, “বলো কী? কীভাবে?” “রেলব্রিজে লিম্পেট মাইন লাগিয়ে ব্রিজটা ওড়ানোর কথা ছিল। আমরা কয়েকজন গেছিলাম ব্রিজের নিচে মাইন লাগাতে। আর ওখানেই আমরা ধরা পড়লাম।” “তারপর?” “মিলিটারিদের জীপে করে আমাদের নিয়া গেল ক্যাম্পে, সেইখানে নিয়া সবাইকে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকাইলো। আর সেই ঘরের মধ্যে দেখি আমাদের মত আরো অনেক মানুষ, দশ বছরের বাচ্চা, পন্ঞ্চাশ বছরের বুড়া, সবাইকে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখছে! সবার গায়ে রক্ত, কারো চোখ উপড়ায় ফেলছে, আবার কারো হাত কেটে ফেলছে! ঘরের দেয়াল, মেঝে সব জায়গায় চাপ চাপ রক্ত!” একটু দম নেবার জন্য থামলো সাজ্জাদ। সে এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো কিছু মেনে নিতে পারছে না।

জোহরা বেগম বললেন,”তারপর কী হল?” সাজ্জাদ দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল। “ঐ অবস্থা দেখে আমি ঐ জায়গায়ই অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। পরে যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখি আমাদের সবার হাত পা বাঁধা। দলের কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম! সবার জামাকাপড় ছিড়া, সারা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মাংস খুবলে খাবলে গেছে! বিশ্বাস করবেন না খালাম্মা, কী ভয়ঙ্কর অবস্থা! ঐ ঘরের বাইরে দুইজন রাজাকার পাহাড়ায় ছিল, তারা একটু পর পর ঘরে ঢুকে একজন দুইজন করে ধরে নিয়ে যাইতেছিল, আর কিছুক্ষণ পর তাদের ফেরত আনত আধা মরা অবস্থায়। একজন একবার পানি খাইতে চাইছিল, আর তখন একটা রাজাকার- একটা রাজাকার তখন তাকে লাত্থি মেরে মাটিতে ফালায় দিয়া তার মুখে পেশাব করে দেয়, আর বলে, নে খা!” এই পর্যন্ত বলেই ফুপিয়ে উঠলো সাজ্জাদ। এতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে সব শুনছিলেন জোহরা বেগম। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন, কয়েক মুহুর্ত নীরবে কাটলো। এরপর নীরবতা ভেঙে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,”তারপর তুমি ছাড়া পেলে কী করে?” সাজ্জাদ তার চোখ মুছলো, তারপর বলতে শুরু করলো, “আমাদের দলের বাবু ভাই আমাদের চারজনকে বলছিলেন,’তোদের যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তোরা বলবি তোরা কিছুই জানিস না। আমি আর হারুন বলব যে আমরা দুইজন মুক্তিবাহিনীর লোক, কিন্তু তোদের কাউকে আমরা চিনি না।

তোরাও বলবি যে তোরা আমাদের চিনিস না। কয়েকজনকে তো অন্তত বেঁচে ফিরতে হবে! ঠিক আছে?’ আমরা আপত্তি করছিলাম, কিন্তু শেষমেষ রাজি হয়ে গেলাম। আমরা সবাই একই কথা বললাম, আমি ছোট বলে আমাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে নাই, কিন্তু অত্যাচার ওরা কাউকেই কম করে নাই!” থামলো সাজ্জাদ। জোহরা বেগম তাকিয়ে রইলেন ছেলেটির দিকে, বাচ্চা একটা ছেলে, তার এখন খেলাধুলা করার কথা; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তাকে তাকে আর বাচ্চা ছেলে হয়ে থাকতে দেয় নি, তার মানসিক বয়স বেড়ে যেন দাড়িয়েছে চল্লিশ বছরে। “খালাম্মা।” “বলো সাজ্জাদ।” জোহরা বেগম জবাব দিলেন। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করলো,”আমার মা কেমন আছে?” একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললেন জোহরা বেগম, ভেবে পেলেন না কী জবাব দেবেন! অনেক কষ্ট করে বললেন,”তোমার মা সারাদিন দরজায় বসে থাকেন, তোমার পথ চেয়ে থাকেন। তুমি যেদিন চলে গেলে সেদিন তোমার মা অনেক কেঁদেছিলেন।” সাজ্জাদ বললো,”জানেন খালাম্মা, মায়ের কথা আমার খুব মনে পড়ে! মাকে ছাড়া কোনোদিন একলা থাকি নাই, আর আজকে কতদিন হইলো মাকে দেখি না!” জোহরা বেগম চুপ করে রইলেন, ভেবে পেলেন না কী বলবেন। সাজ্জাদ আবার বললো,”আমার মাকে বলবেন আমি ভাল আছি।” জোহরা বেগমের মুখে তবুও কথা ফুটলো না, তিনি কিছু শুনতে পেয়েছেন বলেও মনে হল না; তিনি তার ছেলের কথা ভাবছেন।

খোকন, জোহরা বেগমের ছেলে, মুক্তিবাহিনীতে গেছে জুন মাসে। কে জানে, ছেলে তার কোথায় আছে, কেমন আছে! ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় চোখের পাতা ভিজে উঠলো তার।

২. শাড়ীর আচলে চোখ মুছলেন জোহরা বেগম, তারপর চশমাটা চোখে লাগিয়ে তার হাতের কাগজটির ভাজ খুললেন। কিছুক্ষণ আগে একটা ছেলে এসে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে, খোকনের চিঠি। চিঠিটা মেলে ধরে পড়তে শুরু করলেন জোহরা বেগম, “মা, তুমি কেমন আছ? জ্যোতি কেমন আছে? জানো মা, আমি যেই হাত দিয়ে তোমাকে লিখছি, সেই হাত দিয়েই কিছুক্ষণ আগে কবরে লাশ নামিয়ে এলাম। প্রতিদিনই এরকম অনেক লাশ কবরে নামাতে হয় আমাদের; কত রকম মানুষের লাশ, কত ধর্মের মানুষের লাশ, কত বর্ণের মানুষের লাশ- সব লাশের শরীর একই রকম লাল রক্তে রাঙানো, রক্তের লালে সবাই লাল, কার গায়ের কি রঙ, কার কি ধর্ম সব যেন ঢেকে গেছে রক্তের রঙে! সব লাশের গায়ে একই বারুদের গন্ধ! থাক সে কথা। মা জানো, গতকাল রাতে আগে আমরা একটা মিলিটারী ক্যাম্পে অপারেশন করেছি, প্রায় গোটা চল্লিশেক মিলিটারী আর কয়েকটা রাজাকার খতম! আর যেগুলো বেঁচে ছিল,

ওরা সেই লাশগুলো পিছনে ফেলে পালিয়েছে। ওরা আসলে প্রচণ্ড ভীতু, ওরা আমাদের ভয় পায়, সত্যকে ভয় পায়। আচ্ছা মা, জ্যোতি কি নিয়মিত গানের রেওয়াজ করে? ওর কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা তোলার কথা ছিল, মনে আছে? ওকে বোলো, যুদ্ধ যখন শেষ হবে, দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন আমি এসে ওর মুখে গানটা শুনব। ওর কিন্তু আমাকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে শোনাতে হবে। তুমি চিন্তা কোরো না মা। একদিন দেশ স্বাধীন হবে, আমরা যুদ্ধে জিতে আকাশে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়াবো। কথা দিচ্ছি মা, যুদ্ধ শেষে তোমার ছেলে একদিন আবার তোমার কাছেই ফিরে আসবে। ভাল থেকো। জয় বাংলা।” চোখ ঝাপসা হয়ে এল জোহরা বেগমের। তার মনে পড়ল সেই সময়ের কথা, যখন খোকন তার কাছে যুদ্ধে যাবার জন্যে অনুমতি চায়। সেদিন জোহরা বেগম তার ছেলের কথায় আঁতকে উঠেছিলেন। খোকন তার একমাত্র ছেলে, যে কিনা মায়ের রান্না ছাড়া খেতেই পারে না, ঘুমোবার আগে মায়ের মুখ না দেখে ঘুমোতে পারে না, সেই ছেলে বলছে সে নাকি যুদ্ধে যাবে! জোহরা বেগম তার ছেলেকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেন।

কিন্তু ছেলে যে তার নাছোড়বান্দা। এক পর্যায়ে খোকন বলে,”মা, তুমি যেমন আমার মা, দেশটাও তেমনি আমার মা। আমি যদি আমার মায়ের মর্যাদা রক্ষা করতে না পারি, আমার মাকে পশুদের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে না পারি, তাহলে আমি কেমন সন্তান? চোখের সামনে নিজের মায়ের এত অবমাননা দেখেও যদি আমি চুপ করে বসে থাকি, তাহলে আমি কেমন সন্তান?” ছেলের এই কথার পর মা জোহরা বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না, কারণ এর পরে তার আর বলার কিছুই নেই। বেশ অনেকক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন, তারপর চোখের পানি ঢাকার চেষ্টা করে বললেন,”ঠিক আছে, তুই যুদ্ধে যা। আমি আর তোকে আটকাবো না।

তার পরের দিনই খোকন রওনা দেয়, যাবার আগে মায়ের পা ছুয়ে সালাম করে সে বলেছিল,”এই যুদ্ধে কত প্রাণ যাবে কত রক্ত ঝরবে জানি না, কিন্তু এটুকু জানি যে জিতব আমরাই। দেখো মা, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই!” আজ ছেলের চিঠি পড়ে গর্বে বুকটা ভরে উঠলো জোহরা বেগমের। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,”বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই!”

৩. “আপা, আসলেন কইত্থিকা?” জোহরা বেগমকে দেখে পান খাওয়া লাল দাঁত বেঁর করে হেসে জিজ্ঞেস করলেন শরফুদ্দীন শাহ। শরফুদ্দীন শাহ, মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির মেম্বার ছিলেন। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আজ প্রায় তিন মাস পাড় হতে চললো। যুদ্ধ শেষ হবার পর কয়েকদিন একটু চুপ মেরে ছিলেন শরফুদ্দীন, কিন্তু মাত্র তিন মাস যেতে না যেতেই এলাকায় শুরু হয়ে গেছে তার “মুরুব্বী”গিরি। আর এলাকাবাসীরও হয়ত কিছুই মনে নেই।

“এইতো, হাসপাতালে গিয়েছিলাম।” জবাবে বললেন জোহরা বেগম। শরফুদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন,”ছেলের খোঁজ করতে?” “হুম।” একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন জোহরা বেগম, “অনেক হাসপাতালে নাকি অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সা হচ্ছে, তাই গিয়েছিলাম খোকনকে খুজতে।” “খোঁজ পাইলেন কোনো?” “না।” “এতদিন হইলো যুদ্ধ শেষ হইছে, ছেলে ফেরার হইলে তো এর মধ্যেই ফিরত।” শরফুদ্দীন গলার স্বর একটু পাল্টে বললেন, “খোকন বাবাজী কি আসলেই মুক্তিযুদ্ধে গেছিলো? নাকি……” জোহরা বেগম বিরক্তি ঝরা কণ্ঠে বললেন, “আমি আসছি।” বলেই তিনি সামনের দিকে এগোতে যাচ্ছিলেন, তখনই আবার শরফুদ্দীন তাকে থামালেন। “আপা দাড়ান, আপনারে একটা কথা বলা লাগত।” “বলুন।” “আচ্ছা আপা, নভেম্বর মাসে তো আপনার বাসায় মিলিটারী আসছিলো, তাই না?” “হ্যা।” একটা অদ্ভূত ধরনের হাসি খেলে গেল শরফুদ্দীনের মুখে, সে জিজ্ঞেস করলো, “তা, মিলিটারীরা নাকি আপনার মেয়ের ঘরে ঢুকছিলো? কথা সত্য নাকি?” “কী বলতে চান আপনি?” শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন জোহরা বেগম।

“না মানে, তেমন কিছুই বলতে চাই না।” দাঁত বের করে বলে শরফুদ্দীন,”আমি বলতে চাইতেছিলাম যে এইটা ভদ্রলোকের মহল্লা, এইখানে যদি একটা নাজায়েজ চিহ্ন রইয়া যায়….” “শরফুদ্দীন সাহেব!” আর সহ্য করতে না পেরে কঠিন গলায় বললেন জোহরা বেগম, “আপনার লজ্জা করে না নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে এতটা নোংরা কথা বলতে?” আর দাড়ালেন না জোহরা বেগম, দ্রুত পায়ে হাটা ধরলেন তিনি। তার চোখে চিক চিক করছে অশ্রু, এই অশ্রুর মধ্যে আছে একই সঙ্গে অসহনীয় কষ্ট, যন্ত্রণা এবং প্রচণ্ড রাগ!

৪. জ্যোতির ঘুম ভাঙলো চেচামেচীর শব্দ শুনে। বাইরে থেকে একই সঙ্গে অনেক লোকের গলার স্বর ভেসে আসছে, আর তার মাঝে মাঝে দুই একবার শোনা যাচ্ছে তার মা জোহরা বেগমের গলার ক্ষীণ স্বর। “ব্যাপার কী? সকাল সকাল কারা এসে বাসায় হৈ চৈ শুরু করলো?” আপন মনে ভাবলো জ্যোতি, তারপর বিছানা থেকে নেমে তার ঘরের দরজাটা একটু ফাক করে উকি দিল বাইরের দিকে। দেখলো, তার মা দরজায় দাড়িয়ে আছেন, আর বাইরে অনেক লোকজন দাড়িয়ে আছে, তাদের বেশিরভাগই বেশ বয়স্ক, আর তাদের সবার সামনে যেই লোকটি দাড়ানো, সে হচ্ছেন শরফুদ্দীন শাহ।

শরফুদ্দীনের পেছনে দাড়ানো একজন লোক হাত নেড়ে বললো,”না না! কোনো কিন্তু নাই! এই মেয়েকে নিয়ে এই মহল্লায় থাকা চলবে না!” এরপর আরেকজন বয়স্ক লোক বললেন,”এইটা ভদ্রলোকের পাড়া, এই পাড়ার পরিবেশ নষ্ট হোক এইটা আমরা চাই না! তাই ঐ মেয়েরে নিয়া এই এলাকা থিকা বিদায় হন।” “কিন্তু,” দুর্বলভাবে একটু বলার চেষ্টা করলেন জোহরা বেগম, “আমার মেয়েটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব?” জবাবে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন,”সেইটা আপনাদের ব্যাপার! আপনারা মা মেয়ে আজকের মধ্যেই এই এলাকা ছাড়বেন, কেমনে ছাড়বেন কই যাবেন সেইটা চিন্তা করা আমাদের দায়িত্ব না।” জোহরা বেগম মাথা নিচু করে দাড়িয়েই রইলেন, তখন শরফুদ্দীন বললেন,”জিদ করতেছেন কেন আপা? কথা না বাড়াইয়া বাক্স পেটরা গুছানো শুরু করেন।

” শরফুদ্দীনের পাশে দাড়ানো লোকটি বললো,”এইটা ভদ্রলোকের মহল্লা, নষ্ট মেয়ে মানুষ এইহানে থাকলে মহল্লার মান ইজ্জত কিছু থাকব নি?” লোকটির এই কথার সঙ্গে সঙ্গে একসাথে সবাই বলে উঠলো,”হ হ, ঠিক কইছেন! ঠিক ঠিক!” “আপা,” কঠিন গলায় বললেন শরফুদ্দীন,”আমরা ভাল মানুষের কদর করি, আপনার স্বামী ভাল লোক ছিল, আপনেও একজন শিক্ষিত মহিলা। তাই এখনো ভাল মতন বলতেছি। ভালয় ভালয় এলাকা ছাড়েন।” শরফুদ্দীন শাহ এই কথা বলেই ঘুরে দাড়ালেন এবং হাটা ধরলেন। আর তার পিছন পিছন অন্য লোকগুলোও হাটা ধরে, যেন সব কলের পুতুল। দরজা বন্ধ করে দেন জোহরা বেগম, তারপর দরজা থেকে সরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ান তিনি।

তার চোখে পানি, তিনি কাঁদছেন। “মা।” ডাকলো জ্যোতি। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে ফেললেন জোহরা বেগম। মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “কী রে মা? কিছু বলবি?” জ্যোতি জিজ্ঞেস করলো,”ঐ লোকগুলো কেন এসেছিল? আমাদের কেন চলে যেতে বললো?” “সেসব কথা পরে বলব,” বললেন জোহরা বেগম, “এখন যা তো মা, তোর কাপড় চোপড় সবকিছু তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নে।” জ্যোতি আহত গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমাদের সত্যি সত্যিই চলে যেতে হবে মা?” “হ্যা।” “কিন্তু কোথায় যাব আমরা?” “দেখি কোথায় যাওয়া যায়! গ্রামেও চলে যেতে পারি।” “মা।” “আবার কী?” “ভাইয়া যদি ফিরে আসে? এখানে এসে যদি আমাদের না পায়?” জ্যোতির দিকে তাকালেন জোহরা বেগম, তিনি যেমন তার ছেলের জন্য পথ চেয়ে আছেন, এই মেয়েটিও তেমনি তার ভাইয়ের জন্য পথ চেয়ে আছে। “একটা কাজ করা যায় না মা?” জ্যোতি জিজ্ঞেস করে।

“কী কাজ?” “ভাইয়ার জন্য একটা চিঠি লিখে সাজ্জাদের কাছে রেখে যাই। ভাইয়া এলে সাজ্জাদ ওকে চিঠিটা দেবে।” “হ্যা। তাই কর।” “মা।” এবারে একটু কেঁপে উঠলো জ্যোতির গলা। “কী?” জোহরা বেগম জিজ্ঞেস করলেন। জ্যোতি কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া কি সত্যিই ফিরবে?” একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললেন জোহরা বেগম, তারপর বললেন, “ফিরবে। অবশ্যই ফিরবে। সে ফিরে না এলে কীভাবে হবে? তার যে এখনো অনেক কাজ বাকি!”

লেখক: শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img