–সুবহা বিনতে মতিন
প্রিয় মা,
আমি জানি তুমি ভাল নেই। হয়তো ভাল থাকতেও পারো।মিমি ভালো আছে? আর মামুন ও? ভাইয়া তো ভালই আছে জানি।ভাইয়াকে বোলো আামি একটুও রাগ করিনি।সত্যি বলছি আমি কারো উপর রাগ করিনি।আমি তো মেয়ে আমার কি কারো উপর রাগ করা সাজে? জানো মা, আমি এখন আর কাঁদি না। সত্যি বলতে কান্না আর আসে না। সুখে আছি তো। নরম বিছানায় ঘুমাই। সকাল বিকাল ভালো ভালো খাবার, গোসলখানায় ঠান্ডা-গরম পানি দিয়ে গোসল করি। ওহ্ জানো? আমি এখন দুই দিন পর পর চুলে শ্যাম্পুও করি। বুঝতেই পারছ আমি খুবই সুখে আছি, আরামে আছি। শুধু কিছু কথা মনে পড়ে।
তোমাকে একটা কথা বলি? একটা অনুরোধ করি? বাবাকে দয়া করে বুঝিয়ে বলো। মেয়ে বলে মিমির সাথে তোমরা একই কাজ করো না। মিমির একটু যত্ন করো।পারলে একটু পড়ালেখাও করতে দিও। মামুনকে বাবা যত্ন করে, তা আর বলতে হবে না।
আচ্ছা গরু কিনেছ? কি ভেবেছ? আমি কিছু জানি না? আমাকে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে একটা গাভী কিনার কথা ভেবেছিল বাবা। সেই গাভী দুধ দিবে। দুধ বেচলে তোমাদের সংসারটা চলবে, আমি থেকে কি করব বলো? বোঝা সামলাতে কেউ চায় না।
জানো মা, সেদিন বিকালে বাসায় কেউ ছিল না। জানালা দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। খুব ইচ্ছা করছিল বাড়িটা দেখতে। সেই মাঠের মাঝখানে একবার দাঁড়াতে। আমি কিছু টাকা জমিয়েছি।তা দিয়ে একটা সোনার বালা গড়িয়েছি। খুব ইচ্ছা করছিল একবার দূর থেকে বাড়িটা দেখতে। তাই ট্রেনে চেপে বসলাম।
একটানে পৌছেঁ গেলাম গ্রামের স্টেশনে। স্টেশনের পাশেই ভাইয়া তার বন্ধুদের সাথে ক্যারাম খেলছিল। আমাকে দেখেই -ভাইয়া- আতঁকে উঠল। বলল- ‘মুখপুড়ি কেন এসেছিস এখানে?’ বসে থাকা আরেকটা ছেলে বলল, ‘ছেহ! কি মুখ নিয়ে ফেরত এসেছ?’ বললাম- ‘বিশ্বাস করো, আমি ফিরে আসি নি। থাকতেও আসি নি। শুধু দূর থেকে একবার দেখতে এসেছি মাকে আর মিমিকে। আর এই বালাটা মিমির…………..’
ভাইয়া একটানে আমার হাত থেকে বালাটা নিয়ে মাটিতে ফেলে দিল।বলল- ‘তোর অসৎ পথে উপার্জিত অর্থে কেনা কোনো জিনিষ আমাদের ঘরে ডুকবে নাহ।’
দেখতে দিল না তোমায়!
মা, তোমার ঐ আধোভেজা চোখটা কি শুকিয়েছে? জানি শুকিয়ে গেছে। মিমিদের নিয়ে তুমি ভালই আছো। তোমার তো অনেক ছেলেমেয়ে, একজন চলে গেলে কি এসে যায়! কিন্তু আমি? আমার? আমার তো একটাই তুমি। একটাই মা।
তোমাকে আরেকটা অনুরোধ করি। মা আমাকে আর মনে রেখো না। ভাইয়া যেমন ভুলে গেছে, মন থেকে গৃণা করে আমায়, তুমিও ভুলে যাও আমায়।আমি তো মুখপুড়ি। অসৎ পথের পথিক। আমাকে দেখলে ভাইয়ার গা জ্বলে। তাও আমি রাগ করিনি। কিন্তু খুব বলতে ইচ্ছা করছিল, আমি অসৎ, হ্যাঁ আমি অসৎ পথে উপার্জন করি। অসৎ টাকায় খাই। কিন্তু কেন? তোমরাই তো আমাকে বিক্রি করেছিলে। আমি তো বিক্রি হইনি! তোমরাই তো চেয়েছিলে আমাকে ছাড়া গাভী নিয়ে সুখে থাকতে। আমি তো সুখে থাকতে চাইনি! আমি শুধু তোমার মেয়ে হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। অন্যের কেনা পন্য হয়ে, তার চাহিদা পূরণ করে, অসৎ পথে উপার্জন করে আমি তো সুখে থাকতে চাই নি!
কোনো কিছুই তো ভাইয়ার অজানা নয়! তাহলে কেন আমি তোমাকে একবার দেখতে পেলাম না মা? মিমির জন্য আনা বালাটা কেন স্টেশনের পাশে ঘাসে পড়ে রইল?
জানো মা, তোমার দেয়া নামে এখন আর কেও আমায় ডাকে না। কেনা পন্য তো, তাই যার যা ইচ্ছা সেই নামেই ডাকে। ভালই লাগে, প্রতিদিন কত নতুন নতুন নাম পাই!! কয়েক দিন পর পর নতুন মনিব পাই। তোমরা বিক্রি করার পর আরও কতবার যে বিক্রি হয়েছি তার কোনো হিসাব নেই।
আমার কি দোষ ছিল? মেয়ে হওয়া টাই কি একমাত্র কারণ?ছেলে হলে তো অন্তত বিক্রি করতে না।আচ্ছা বলতে পারো কেন আমাকে প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়?এই না জানি নতুন মনিব এলো?আজকে আবার কেউ কিনতে আসবে না তো?কেন আমার সাথেই………….
(তাড়াতাড়ি করে পৃষ্ঠাগুলো কোনোরকমে ভাঁজ করে ঝোলার মধ্যে রেখে দিল মিনু। মনিব এসে পড়েছে। এখন তার সেবা করতে হবে যে! হয়তো বা আরও অনেক কিছু লিখবে আরেকদিন। কিন্তু সে জানে, তার এই লিখাগুলো কেউ পড়বে না এমনকি তার মা ও না। ঐ ঝোলার মধ্যেই অগোছালো পৃষ্ঠা হয়ে রইল মিনুর ক্যানভাস)