Sunday, April 27, 2025
28 C
Dhaka

মাতা মেরীর প্রাঙ্গণঃ নটরডেম কলেজ

মৈনাক কুমারঃ-

জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু মূহুর্ত কাটিয়েছি নটরডেম কলেজে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের যান্ত্রিক জীবন ফেলে এ যেনো এক নতুন প্রাণোচ্ছল নৈসর্গিক ভূবন। আমার স্কুল জীবন কেটেছে আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে, তার পাশেই নটরডেমের ক্যাম্পাস।নটরডেম কলেজের আশেপাশে দিয়ে অনেক যাওয়া-আসা হয়েছে,বাবা-মা বলতেন এখানে বাংলাদেশের সেরা শিক্ষার পরিবেশ রয়েছে,তখন থেকেই এখানে পড়ার সুপ্ত বাসনা তৈরী হয়েছে। প্রথমবারের মতো নটরডেম প্রাঙ্গণে ঢোকার সুযোগ পাই ক্লাস এইটে পড়ার সময়।সেবার নটরডেম কলেজের কোনো এক ফেস্টে পার্টিসিপেন্ট হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম। গেট দিয়ে প্রবেশ করেই দেখা গেল একটা ম্যুরাল চিত্রকর্ম, একজন মা তার শিশুকে অক্ষরজ্ঞান দিচ্ছে।

তারপর আস্তে আস্তে পুরো নটরডেম প্রাঙ্গণ ঘুরতে ঘুরতে অভিভূত হওয়ার মাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগল।প্রায় শতবর্ষী হ্যারিংটন ভবন তার সাথে লাগোয়া আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ভবন,নির্মাণাধীন ফাদার টিম ভবন,মার্টিন হল,নাইট স্কুল,ফাদার ম্যাথিউস ভবন সবকিছুতেই কেমন যেনো এক ঐতিহ্য এর ছোয়া লেগে রয়েছে। তারপর হাটতে হাটতে গেলাম মাঠে,সতেজ ঘাস আর এতো স্বাচ্ছন্দ্যময় গাছা-গাছালি দেখে সকল ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। এই ক্যাম্পাস ঘুরেই মনের সেই সুপ্ত বাসনা তীব্র বাসনায় পরিণত হয়।মন প্রাণ দিয়ে চেয়েছিলাম যাতে আমি এই কলেজে পড়ার সুযোগ পাই,সৃস্টিকর্তা আমাকে নিরাশ করেননি ২০১৭ সালে নটরডেম কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভর্তি হই। তারপর ক্লাস শুরু,নটরডেমের কলেজের যেই জিনিসটা সবচেয়ে চমকপ্রদ, তা হলো তাদের সময়ানুবর্তিতা প্রতিদিন সকাল ৮ টায় ক্লাস শুরু হতো, কখনোই তা ৮ টা ১ মিনিট বা ৮ টা ২ মিনিট হবে না।

কলেজে পেলাম ভাতৃসম কিছু বন্ধু। এমন ভাবে দিন গুলো আস্তে আস্তে কাটতে লাগলো,এর মধ্যেই আবার মতিঝিল এর বিখ্যাত জলাবদ্ধতার অববাহিকায় নটরডেম ভেসে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও করা হয়েছে শুরুর দিনগুলোতেই।তারপর শুরু হলো কুইজ,আপনারা হয়তো অনেকেই এই কুইজ এর সাথে পরিচিত না,এই জিনিসটাই প্রতিটা নটরডেমিয়ান কে দৌড় এর উপরে রাখে। কুইজ জিনিসটা হলো একটা ছোটো খাটো টিউটেরিয়াল এক্সাম(২০/২৫ মার্ক এর এক্সাম কে ১০০ তে রুপান্তর করা হয়) এমন কুইজ এর সম্মুখীন প্রত্যেক নটরডেমিয়ান কে হতে হয় জন্মালে যেমন মরিতে হয়,তেমনি নটরডেমে ভর্তি হলে কুইজ দিতেই হয়।

মুষলধারে বৃষ্টি, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিছুই এই কুইজকে থামাতে পারে নাই।এই কুইজ জিনিস টাই অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নটরডেমকে আলাদা করে।অভিশাপ মনে করা এই কুইজ গুলোই যে নটরডেমিয়ানদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কতোটা আত্মবিশ্বাসী করে তা বলে বোখানো যাবে না। এমন কুইজ দিতে দিতে ফুড়ুৎ করে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শেষ,এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেবার পালা। এবার অপেক্ষা করছে,আরেক চমক।নটরডেম কলেজ কতৃপক্ষ ৮৫% উপস্থিতির নিচে কোনো ছাত্রকে প্রবেশপত্র দেয় না,তাকে যতোটুকু ঘাটতি রয়েছে তার জন্য সশ্রম মেকাপ করে প্রবেশপত্র নিতে হয়।

অনেক অপদার্থ এমন নৈসর্গিক ক্যাম্পাসে থাকতেও ক্লাস বাংক দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত তাদেরই এটেন্ডেন্স এ ঘাটতি থাকার জন্য মেকাপ করতে হতো, বলা বাহুল্য আমিও এদের দলের একজন। আমার টেস্ট এর রেজাল্ট ভালো হওয়া সত্বেও এটেন্ডেন্স শর্ট থাকার কারণে আমার অভিভাবক তলব করা হলো।বাবা মারাত্মক কড়া,তাকে নেয়া যাবে না,এসব শুনলে তিনি আমাকে ওখানেই ঠ্যাঙানো শুরু করবেন। তাই হালকা মডারেট মা কে নিয়ে গেলাম।সেখানে গিয়ে শুনলাম আমার এটেন্ডেন্স ৬০%,অর্থাৎ ২৫% শর্ট।এখন আমাকে মেকাপ করতে হবে।

মেকাপের ধাপ দুটি: প্রথমত, প্রতি পার্সেন্টের জন্য দু ঘন্টা কাজ করতে হবে(অর্থাৎ আমার কাজ করতে হবে ২৫×২=৫০ ঘন্টা)। দ্বিতীয়ত, প্রতি পার্সেন্টের কারণে ১০০ টাকা করে জরিমানা(অর্থাৎ আমার জরিমানা ২৫০০ টাকা)। এই ধাপ গুলো পার করলেই আমি ক্লিয়ারেন্স পেপার পেয়ে প্রবেশপত্র পাবো,শুরু হলো আমার সশ্রম সাজা। আমরা ৫০-৬০ জন কালপ্রিট মিলে শুরু করলাম কাজ আমাদের কাজ ছিলো নটরডেমের ক্যাম্পাস পুরোটা ধোয়ানো,ঝরা পাতা টোকানো,কাকের মল পরিষ্কার করা,ক্যাম্পাস ঝাড়ু দেয়া ইত্যাদি।এই সব কাজে সাজার চাইতে মজা বেশী ছিলো। বন্ধুবান্ধব মিলে এইসব করার সময় যে কতো মজা করেছি, তা মনে করলে নস্টালজিক হয়ে যাই। সাড়ে ৮ দিন এর কাজ করার পেলাম ক্লিয়ারেন্স, এই জিনিসটা আমাকে শ্রমের মূল্য শিখিয়েছে, বেড়েছে এই ধরনের কাজ করা মানুষ দের প্রতি সম্মানবোধ।তারপর কলেজে ছাড়ার সময় হয়ে গেলো,দৈর্ঘ্যের দিক থেকে স্বল্প হলেও এই তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের ইতি ঘটল।এখনো সময় পেলেই ছুটে যাই নটরডেমের প্রাঙ্গণে। ইচ্ছে করে সেই ক্লাস গুলোয় বসে ক্লাস করতে, কিন্তু কে দিবে আমায় সে সুযোগ। শেষে একটি কথা বলেই মনকে বুঝ দেই, তা হলো: Once a Notredamian, Always a Notredamian

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img