Tuesday, April 29, 2025
24.2 C
Dhaka

এক টুকরো জীবন

নিসা মাহজাবীন লাবণ্য

তানিয়ার রুমে আজ লাইট জ্বলছে না। অন্ধকারে বসে আছে চুপচাপ। অন্যদিন এমন সময় ও পড়তে থাকে টেবিলে। দশটার দিকে মা দুধ নিয়ে আসেন এক গ্লাস। ওটা খেয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে তানিয়া। বাবার নিয়মকানুন বেশ কড়া রাত সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমাতে যেতে হবে। উঠতে হবে ভোর পাঁচটায়। অন্ধকারে ঘড়ি দেখা না গেলেও তানিয়া বুঝতে পারছে ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুঁইছুঁই মা দুধ নিয়ে আসেনি আজ। বাবাও ধমক দেয়নি ঘুমাতে এত দেরি হচ্ছে বলে। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগছে। আকাশের গোল চাঁদটা আজ বড় বেশি আলো ছড়াচ্ছে। বাগান থেকে ভেসে আসছে হাসনাহেনার ঘ্রাণ। চমৎকার একটা পরিবেশ। কিন্তু এসব কিছুই আজ তানিয়াকে স্পর্শ করছে না। বাতাসে উড়ে এসে মুখে পড়া চুলোগুলোও সরাতে ইচ্ছে করছে না ওর। অনবরত কামড়াতে থাকা মশাগুলোকেও পাত্তা দিচ্ছে না।

 

ঘাড় ঘুড়িয়ে দরজার দিকে তাকালো। পাশের রুম থেকে হালকা আলো ওর রুমে আসছে। কোন সাড়া শব্দ নেই কারো। ভয়াবহ নি:স্তব্ধতা। তানিয়া জানে না কী হচ্ছে পাশের রুমে। সন্ধ্যার ঘটনাটা মনে হতেই আবার আঁতকে উঠলো। বাবাকে এমন ভাবে রাগতে আগে কখনও দেখেনি। দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই তানিয়ার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। জীবনে প্রথমবার বাবার হাতে মার খেলো সে! হতচকিত হয়ে গেলেও ঐ মুহুর্তে বাবার মুখের দিকে তাকানোর সাহস ছিল না ওর। ঠোঁটের কোণে রক্ত নিয়ে শুধু ভাবছিল, একি তার সেই চিরচেনা বাবা তানিয়ার মাও তাকাতে পারছিলেন না স্বামীর দিকে। আঁচলে মুখ চেপে নি:শব্দে চোখের পানি ফেলছিলেন তিনি। একটু পর পর তাঁর কেঁপে উঠা শরীর দেখলেই বোঝা যায় তিনি কাঁদছেন। আবার চাঁদটার দিকে তাকালো তানিয়া। ওর ছোট ভাইটা ঘুমাচ্ছে। বাসার এমন থমথমে পরিবেশ তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। মানুষের বোবা কান্না বোঝার মত বয়স এখনো তার হয়নি। পরম নিশ্চিন্তে সে ঘুমাচ্ছে। তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেমন!

 

বুকের ভেতর কী যেন একটা পাথরের মতো চেপে বসেছে! সময়ের সাথে সাথে ভারী হচ্ছে অদৃশ্য পাথরটা। সহ্যর সীমা অতিক্রম করলে নিশ্চয়ই একটা কিছু করে বসবে ও! কী করবে? টেবিলের কাপড়ের নিচে রাখা ব্লেডটা নিয়ে কবজিতে পোচ দিবে নাকি ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে সেটা গলায় পরে নেবে? কোনটা বেশি সহজ? দ্বিধান্বিত হয়ে গেল তানিয়া। আচ্ছা, ও মরে গেলে কেউ কি ভাববে ওর কথা? খেতে বসে মার চোখে কি পানি আসবে মেয়ের কথা ভেবে? অসুস্থ হলে মাথায় হাত বুলানোর জন্য বাবা কি খুঁজবেন তাকে? মনে হয় না! বাবা তো বলেই দিয়েছেন, “আজ থেকে আমি তোর বাবা নই”! আর মা! “তুই মরিস না
কেন, তুই মর”, বলেই ছুটে বেড়িয়ে গেছেন রুম থেকে। ঠিকই তো! তানিয়ার এখন বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। ওর মত মেয়ের মরে যাওয়াই উচিত। কাজটা করার আগে একবারও কি সে ভেবেছিল ওদের কথা? ভেবেছিল কি তাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবেন ওর মা? রাতে কিভাবে দু’চোখের পাতা এক করবেন? প্রতিদিনকার মতো অফিস থেকে ফিরে ‘মামণি’ বলে উঁকি দেওয়া বাবা নামক মানুষটা কীভাবে দিন পার করবে? ছোট ভাইটাই বা কার কাছে ওর আবদার গুলো করবে? “আপু, ভাতটা খাইয়ে দাও না। আপু, আমি কার্টুন দেখব, তুমি সরো”। কাকে বলবে ওর বায়নাগুলো? সে কি ভেবেছিল এগুলো? না, ভাবে নাই। তাহলে এখন কেন? সে তো বাইরের একটা ছেলের জন্য নিজের ফ্যামিলিকে ত্যাগ করে দিয়েছিল। অচেনা গলি দিয়ে পালানোর সময় ছোট চাচ্চু ওকে ধরে এনেছে। আশেপাশের মানুষগুলো কী অদ্ভুতভাবেই না তাকিয়ে ছিল!

 

বাবার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। মানুষটার বয়স যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছে। নিজ হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারটা এক মুহুর্তেই ভেঙে গেল তাসের ঘরের মতো। ছোট চাচ্চু, মেজ চাচ্চু, বড় ফুপি, ওদের অগ্নিদৃষ্টিতে যেন ছাইভস্ম হয়ে যাচ্ছিল তানিয়া। যাওয়ার আগে সবাই বলে গেলেন এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল! সে কি শুধু তার বাবার মানসম্মানই ডুবিয়েছে? ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে তাদেরও। বাবা তাদের কোন কথারই উত্তর দিলেন না। শুধু তানিয়াকে টেনে নিয়ে গেলেন ভেতরের ঘরে। তারপর জীবনে প্রথম হাত তুললেন মেয়ের গায়ে! বললেন, “আজ থেকে আমি তোর বাবা নই”। টেবিল ক্লথ তুলে ব্লেডটা খুঁজছে তানিয়া। পাচ্ছে না কেন! এখানেই তো থাকার কথা! অন্ধকারে হাতরাতে লাগলো সবকিছু। উফ! বাবার মুখটা কেন এত মনে পড়ছে? কেন ইচ্ছে করছে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে, “আই এম স্যরি বাবা!” ইচ্ছে করছে আবারও
বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া সেই দিনগুলিতে ফিরে যেতে। তানিয়ার দু’চোখ টলমল করে উঠে নোনা জলে। নাহ, সে যে অন্যায় করেছে তার কোন ক্ষমা নেই। বাবা মার সামনে দাঁড়ানোর সাহস নেই ওর। এত এত মানুষের ঘৃণা নিয়ে বাঁচতে পারবে না সে। তার মরে যাওয়াই ভাল! সে মরবে! আজ এবং এক্ষুনি! ঠিক সেই মুহুর্তে হাতে ঠেকে গেল ব্লেডটা। কাঁপা কাঁপা হাতে খুলে ফেলল কভার। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠলো ব্লেডের কিনারা। শেষবারের মতো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো তানিয়া। চাঁদটা ঢাকা পড়ে গেছে মেঘের আড়ালে। তানিয়া অনুভব করলো অন্ধকারে দুলতে থাকা গাছগুলোর নড়াচড়া। শেষবারের মতো বুক ভরে টেনে নিল হাসনাহেনা ফুলের সুবাস, যেটা ও লাগিয়েছিল নিজ হাতে। বিদায় তোমাদের বিদায়! ব্লেডটা ছুঁইয়ে দিল বাম হাতের কবজিতে…

 

হঠাৎ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তানিয়ার। মরে গেছে নাকি ও! এত তাড়াতাড়ি! কোন যন্ত্রনাই পেল না! মৃত্যু এত সহজ! ওই তো বাবা! কাছে এগিয়ে আসছে। কুঁকড়ে গেল তানিয়া। পিছিয়ে যেতে লাগলো দেয়ালের দিকে। বাবা আরো এগিয়ে এসে খপ করে ধরে ফেললেন তানিয়ার হাত। ব্লেডটা দু’টুকরো করে ছুঁড়ে ফেললেন বাইরে। “তোর এত বড় সাহস! আমরা কি তোর কেউ না? তুই এটা কি করতে যাচ্ছিলি?” এই বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। তানিয়া মাথা নিচু করে আছে। ও যে মরে যায়নি এখনো সেটা বুঝলো বাবার হাতের স্পর্শ পেয়ে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছেন বাবা। তানিয়া ফুঁপিয়ে উঠলো। ফিসফিস করে বলে ফেলল না বলা প্রিয় কথাগুলো..”আই এম স্যরি বাবা, আই লাভ ইউ সো মাচ”… স্মিত হেসে মেয়েকে বললেন বাবা, “সন্তান জন্ম দিলেই বাপ হওয়া যায় নারে মা! এখানেই তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সাথে বাবার পার্থক্য! সন্তান কখনো পর হয় না বাবা-মায়ের কাছে। এই কথাটা মনে রাখিস। আমি তোকে ক্ষমা করে দিলাম”। তানিয়া টের পেল পাশ থাকে মাও কখন যেন এসে জড়িয়ে ধরেছে। সেই সাথে খেয়াল করলো, বুকের পাথরটাও কখন যেন হালকা হয়ে নেমে গেছে!

 

দশ বছর পরের কথা। সেদিনের তানিয়া আজ দেশের একজন স্বনামধন্য ডাক্তার। যে জীবনটা সেই রাতে সে শেষ করে দিতে চেয়েছিল সেই ছোট্ট প্রাণটা এখন আরো শত মানুষের জীবন রক্ষা করে। তার কাছে এসে মানুষ নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পায়। তানিয়ার বাবা হাসিমুখে বসে আছেন বারান্দার ইজিচেয়ারে। তিনি ভালভাবেই জানেন মেয়ে আজও এসে একগাদা বকা শোনাবে, “এখনো ঔষুধটা খেলে না বাবা? আর পারিনা তোমাকে নিয়ে, তুমি ইচ্ছা করে এমন কর তাইনা?” মেয়ের কথা শুনে তিনি মুচকি হাসবেন। এরপর বাড়িয়ে দেবেন তার শীর্ণ হাতটা। সেই অস্থিচর্মসার হাত পরম মমতায় আঁকড়ে ধরবে তানিয়া। অস্ফুটে বলে উঠবে, “আই লাভ ইউ সো মাচ বাবা, মিস ইউ সো মাচ…”

তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছেন, একজন বাবা অপেক্ষা করে আছে…

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img