আশরাফুল আলম রাজু
দূর থেকে হালকা বায়ে মৃদু হিমেল হাওয়া বইছে।বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে থাকা হিমুর শরীরে এই হাওয়া যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি খেলে গেল। হিমু সচারচর এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে না। কিন্তু আজ তার মন কেন জানি খুব উৎফুল্ল। কিছুক্ষন পায়চারি করার পর সে রুমে এসে গোসল করতে বাথরুমে গেল। হঠাৎ বাথরুমের দরজায় লাগানো একটা চিরকুট দেখে সে দাড়িয়ে গেল। চিরকুটে মেসের চারমাসের ভাড়ার হিসাব দেয়া আছে। হঠাৎ তার মনে হলো আরে এ কাজ তো মেসের ম্যানাজার ছাড়া কেউ করে না। তার মানে তিনি কি ফিরে এসেছেন? এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন তা সে জানে না। টাকার কথা আসায় তার রূপার কথাও মনে হলো। আরে আজ কতদিন তার সাথে কথা হয়না। সেও মনে হয় কোথায় বেড়াতে গেছে। কিন্তু আমাকে না জানিয়ে তো কখনও কোথাও সে যায়নি। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে হিমু নতুন একটা হলুদ পান্জাবি পরে দ্রুত নিচে নামলো। উদ্দেশ্য রূপাকে ফোন করা। মেসের ম্যানাজারের রুমে একটা ফোন আছে। হিমু ভয়ে ভয়ে রূপার নাম্বারে ফোন দিল।
-হ্যালো,কে বলছেন?
-আমি হিমু বলছি। কেমন আছো?
-এতোদিন পরে। কোথায় ছিলে তুমি?
-সব বলবো। তোমাকে আজকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।
-কোথায়?
-তুমি রেডি হয়ে থাকো আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো,এখন রাখি।
রূপা জানে হিমু এমনই। তাই ফোন রেখে সে তৈরী হতে লাগলো।
শুভ্রের আজকাল কেমন যায় তা আমরা কেউ জানি না। তবে আজ সকাল থেকেই তাকে যেন কেমন চঞ্চল লাগছে। অনেকদিন তার সম্পর্কে কোন খোঁজখবর পাই নি। তাই তাকে হঠাৎ দেখে ঘাবড়ে গেলাম। কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। বারান্দায় দাড়িয়ে সেই সকাল থেকেই শুধু চশমা মুছছে। মনে হয় অনেকদিন পর কোথায় যাবে। অনেকক্ষন পর আমার ধারনা সত্যি করে সে হনহন করে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।
ঐ দিকে মিসির আলির তো অনেকদিন ধরে কোন খবর নেই। মনে হয় নতুন কোন রহস্যের ঝট খুলতে ব্যস্ত। তবে আজ তাকে বেশ ফুরফুরা দেখাচ্ছে। সাদা কাগজে গতকাল থেকেই কি জানি লিখছে ।হয়তো কোনো রহস্যের সমাধান। সকালে একটা ঘামে কাগজটা ভরে তার উপরে কী যেন লিখে ঘামটা নিয়ে কোথায় বের হয়ে গেলেন? কী জানি আবার হয়তো গা ঢাকা দিলেন।
রূপা হিমুর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু হিমুর কোনো দেখা নেই । একবার ভাবলো চলে যাই । আবার ভাবলো না থাক অনেকদিন দেখা হয়না। এই হিত-বিপরীত ভাবনার সময় হঠাৎ দেখে হলুদ পান্জাবি গায়ে কে যেন উর্ধ্বগতিতে হেটে আসছে। রূপার চিনতে আর বাকি রইলো না এই তার হিমু। হিমু রূপার কাছে এসেই কিছু না বলে রিক্সা ডেকে রিক্সার চালককে কি জানি বললো। তারপর রূপাকে ইশারায় রিক্সায় উঠতে বললো। রূপাও কিছু জিজ্ঞাস না করে রিক্সায় উঠে বসল। রিক্সা চলতে লাগলো।
শুভ্রের হাতে একটা স্মার্টফোন। বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার! কার সাথে যেন কথা বলছে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে। কিছুক্ষন পর দেখি একটা উবার গাড়ি চলে এসেছে। শুভ্র গাড়িতে বসল আর গাড়ি ও অদৃশ্য হতে লাগলো।
কিন্তু মিসির আলিকে আর ফলো করা গেল না। কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন।
হিমু আর রূপার রিক্সা বিশাল একটা বাড়ির সামনে থামলো। দুজনের হাতেই বাধানো ফুলের তরী। বিশাল বাড়িটায় কোন সাড়াশব্দ নেই। তারা নীরবে হাত ধরাধরি করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষন হাটার পর তারা কিছু একটা দেখে থমকে গেলো। তাদের থেকে হাত দশেক দূরে এক বয়স্কলোক হাতে কি একটা ঘাম নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের আগে কে আসলো তারা ভাবতে লাগলো। বিস্ময়ে রূপা যখন চারদিকে দেখতে লাগলো ।হঠাৎ পিছনে দেখে চশমা চোখে,হাতে বিশাল রঙিন কাগজে মোড়ানো কি একটা নিয়ে একটা সুদর্শন ছেলে দাড়িয়ে আছে। রূপা -হিমু দুজনেই বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল। সামনের লোকটা হাটা শুরু করলে। হিমুও রূপার হাত ধরে তার পিছনে পিছনে পা ফেলল। তাদের পিছনেও শুকনো পাতার উপর পা ফেলার শব্দ হচ্ছে।
কিছুক্ষন হাটার পর তারা একটা বড় বাধানো পুকুর পাড়ে এসে দাড়ালো। পুকুর ঘাটের দিকে তাকাতেই তারা দেখলো চাদুর জড়ানো গায়ে কে যেন পুকুর পাড়ে বসে কী লিখছে। চারজনই এবার পাশাপাশি এসে দাড়ালো। সবাই বিস্মিত হয়ে মনে বলল-আরে হিমু, আরে শুভ্র ,আরে মিসির আলি! হঠাৎ কার পায়ের আওয়াজে তাদের বিস্ময় ভাঙ্গলো। তাদের হাত থেকে ফুল ,ঘাম, রঙিন কাগজে মোড়ানো বাক্স নিয়ে লোকটা আবার আগের জায়গায় বসল। তারাও তার পিছু পিছু গেল। তারা লক্ষ্য করলো লোকটার চোখের কোনে জলকনা জড়ো হচ্ছে। কিছুক্ষনের নীরবতা ভেঙ্গে লোকটা বলল-“আমি দুঃখিত, তোমাদের দেয়ার মতো আমার কিছুই নেই। আজ যেমন আমার জন্মদিন ঠিক তেমনি তোমাদেরও জন্মদিন। কারন আমার জন্মের সাথে ই তো তোমাদেরও জন্ম।শুভ জন্মদিন তোমাদের সবাইকে।