Sunday, April 27, 2025
28 C
Dhaka

যাইফ মাসরুর-এর গল্প : একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু

 

| ১ ||

রাতুলের আম্মা প্রমাণ সাইজের একটা ব্যাগ দিয়ে রাতুলকে বাজারে পাঠিয়েছেন। ঘর থেকে বের হবার সময় বরাবরের মতো কতগুলো উপদেশ মার্কা শুনিয়ে দিয়েছেন—রাস্তায় কোথাও দাঁড়াবি না, বাজারে গিয়া হাবিজাবি কিছু খাবি না, জলদি বাড়ি ফিরবি, মাইনষের ক্ষেতের মাঝখান দিয়া হাঁটবি না, ঠইকা আসবি না ইত্যাদি।

রাতুলের মুখস্ত হয়ে গেছে কথাগুলো। তার আম্মা এসব বলতে শুরু করলে কী বলতে হয়, মুখটা কেমন করা লাগে, সবই রপ্ত আছে তার। হু, আইচ্ছা, ঠিকাছে বলে সে ঘর থেকে বের হবার জন্য প্রস্তুত হলো।

বের হবার সময় আম্মা বললেন, ”দোয়াডা পইড়া বাইর হ, পথঘাটের কথা কওন যায় না।” রাতুল তার আম্মার দিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে ঢোক গিললো। চেহারায় খানিকটা ভীতু ভীতু ভাব। তার আম্মা রাগী রাগী গলায় বললেন, ”কী, তুই এই দোয়াডা পারোস না, আবার ভুলসোস তুই। তুই আমারে কোন জাহান্নামে নিতে চাস, হ্যাঁ?” আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আল্লাহ আমারে উঠাই নাও।” একটু থেমে কেশে নিলেন, আবার বলতে শুরু করলেন, ”পড়, আমার লগে লগে ক—বিসমিল্লাহে তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ।” তার আম্মার সাথে তাল মিলিয়ে দোয়াটা পড়লো রাতুল। তারপর রাতুলের আম্মা তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ”যা, জলদি ফিরা আসবি।” রাতুল মাথা নেড়ে ছোট্ট করে বললো, ”আইচ্ছা।”

সর্বনাশ!
কিছুদূর এসেই নিজের ভুলটা টের পেলো রাতুল। পকেট থেকে কিছু টাকা পড়ে গেছে, কিন্তু কোথায় পড়েছে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা।

রাস্তার পাশে একটা কড়ই গাছে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো সে। ভাবছে তার আম্মাকে কোন কথা বলে বিশ্বাস করাবে—টাকাটা সে আচার কিংবা মুড়ালি খেয়ে খরচ করেনি, দুর্ঘটনাবশত টাকাগুলো রাস্তায় কোথাও পড়ে গেছে।

আম্মার বলে দেয়া জিনিসগুলো বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে হয়েও যেতে পারে। রাতুল মনে করতে লাগলো—
এককেজি সিম।
এককেজি বেগুন।
এককেজি টমেটো।
দুইটা ফুলকপি।
একটা বাঁধাকপি।
আধাকেজি মটরশুঁটি।
এক বিড়া পান।
আরেকটা কী আইটেমের কথা যেনো বলেছিলেন আম্মা, এই মুহুর্তে ইয়াদ হচ্ছে না সেটা।

টাকা গুনে দেখা গেলো, যেই টাকা আছে তাতে সবগুলো কিনতে না পারার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও বাজারে গিয়ে দেখা উচিত। দূর থেকে অনুমান করে বসে থাকলে চলবে না। বাজারের পথে হাঁটতে হাঁটতে ভুলে যাওয়া জিনিসটার কথা মনে করার চেষ্টা করছে সে, কাজ হচ্ছে না।

*

বাজারে ঢোকার মুখেই চালের আড়ত। ইয়া বিশাল বিশাল দোকান একেকটা। মহাজনরা একেকজন কয়েকমন করে ভুঁড়ির মালিক। তারা তাদের সেই সুবিশাল ভুঁড়ি নিয়ে ক্যাশের বড় চেয়ারটাতে বসে আছেন। দোকানের নামগুলোও বেশ চটকদার—দয়াময় চাউল ভান্ডার, খাজাবাবা রাইচ হাউজ, মায়ের দোয়া চাউলের দোকান ইত্যাদি।

রাতুলের চোখ আটকে গেলো “খাজাবাবা রাইচ হাউজ”-এ। দোকানের মালিক বিশিষ্ট ভুঁড়িঅলা ব্যক্তি, মুখে দশাসই গোফ আছে, মাথায় হাল্কা টাক ধরেছে। তিনি দোকানের সবচেয়ে বড় চেয়ারটাতে বসে আছেন। তার মাথা বরাবর উপরে এক সুফি সাধকের ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে টানিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্রেমের উপর একটা নীল-লাল রঙের কাগজের ফুলের মালা ঝোলানো। পাশে দুটো স্টিকার লাগানো। একটিতে লেখা “আল্লাহ সর্বশক্তিমান”, অপরটিতে লেখা “মা-বাবার দোয়া”।

তার সামনে কয়েকজন ব্যক্তি বসে আছেন। ধুন্ধুমার আড্ডা হচ্ছে। তাদের সামনে চায়ের কাপ, পানের বাটা রাখা আছে। আড্ডার ফাঁকেফাঁকে তারা এসব চেখে নিচ্ছেন অল্পবিস্তর।

সমকালীন কিছু ইস্যু নিয়ে তারা আলাপচারিতায় মেতে উঠেছেন। মহাজন সাহেব বিজ্ঞের মতো গোফে হাত দিয়ে আলাপ শুনছেন, মাঝেমাঝে একটা দুইটা মন্তব্য করে উঠছেন আবার অন্যের মন্তব্য শুনে মাথা নাড়ছেন।

রাতুলের এসবে নজর নেই, আগ্রহও নেই। দোকানের টিনের চালার উপরে একটা কবুতরের খুপরিতে চোখ আটকে গেছে তার। খুপরিতে দুটো কবুতরের বাচ্চা দেখা গেছে। এখন বাচ্চাদুটো রাতুলের চাই-ই চাই। কীভাবে নাগাল পাওয়া যায়, সেটা নিয়ে ফন্দিফিকির শুরু করেছে সে।

দোকানের পেছন দিকটা একটু জংলা আর নিরিবিলি। এদিকটায় বিশেষ দরকার ছাড়া খুব একটা আসে না কেউ। ময়লা মাটিতে ছোট ছোট কিছু কচুগাছের দেখা মিললো, একটু দূরেই ঝংধরে লালচে রঙ ধারণ করা টিউবওয়েল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। দোকানের টিনের দেয়াল ঘেঁষে তিনটে সুপারি গাছ আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে বেড়ে উঠছে। রাতুল ভাবলো, এই সুপারি গাছ বেয়ে টিনের চালে উঠে গেলে মন্দ হয়না।

সুপারি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো। তেমন কিছুনা না অবশ্যি, চালে উঠে আস্তে হাঁটতে হবে, আওয়াজ করা যাবেনা, কারো চোখে পড়া যাবে না। এই যা।

কাজে লেগে গেল রাতুল। গায়ের শার্ট খুলে গাছ বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যেতে লাগলো। প্রথবারের মতো টিনের চালে পা রাখতেই কটর-মটর করে শব্দ হতে শুরু করলো। সাবধান হয়ে গেল সে। আগে থেকে আরো সাবধানী হয়ে কবুতরের খোপের দিকে এগুতে লাগলো সে। আরো দুয়েকবার কটর-মটর আওয়াজ হলো, তবে মানুষের হইচইয়ে কারো কানে পৌঁছার আগেই মিলিয়ে গেল।

খোপের কাছে যেতেই আনন্দে নেচেে উঠতে চাইলো রাতুল। তবে এখন এসব ছেলেমানুষি করলে চলবে না। চুপচাপ নেমে যেতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব। বাচ্চাদুটো একবার হাতে নিয়ে দেখলো সে। চিঁ চিঁ করে ডাকতে শুরু করলো বাচ্চাদুটো। প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখা ব্যাগটা বের করলো সে, আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ দেখছে কিনা, তারপর চট করে বাচ্চাদুটোকে ব্যাগের ভেতর ভরে নিলো।

এবার নেমে আসার পালা। আবারো সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে এগুলো রাতুল। সুপারি গাছের কাছে এসেই টের পেলো নামাটা সহজ হবেনা। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বিশেষ কায়দায় কবুতরের ব্যাগসহ গাছ বেয়ে নেমে এলো সে।

*

বাড়িতে ঢুকতেই বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো রাতুলের। আম্মাকে কী বলে বুঝ দেয়া যায়? একটু থেমে আবার সামনের দিকে পা বাড়ালো। অন্তরে আল্লা-বিল্লা জপছে খুবকরে। যেন এ যাত্রায় বেঁচে গেলেই বাঁচে, আর হবেনা এরকম।

— ”ব্যাগ এতো খাইল্লা দেখায় ক্যান? বাজারে পাস নাই কিছু?” পেছন থেকে রাতুলের আম্মা বললেন।
— ”আইজকা বাজারে তেমন কিছু উঠে নাই, যাও দুয়েকটা উঠসে–দামচড়া। তাই খালি হাতেই ফিরা আইলাম।” কথাখানা বলে জিভ কামড়ে ধরলো, মিথ্যা যে বলে ফেললো, এখন সব টাকা ফিরিয়ে দেবে কীভাবে? পথে না কিছু টাকা পড়ে গেছিলো?
— ”টাকা যা দিসিলাম, সবগুলি গুইনা টেবিলের উপর রাখ।”
— ”কিন্তু আম্মা, আমি তো কিছু টাকা খরচ কইরা ফেলসি।”
— ”রাস্তার হাবিজাবি আবার খাইসস তুই।”
— ”না কবুতরের বাচ্চা কিনলাম, এই যে দেখো।” কথাটা বলেই ব্যাগটা খুলে তার আম্মার সামনে মেলে ধরলো সে।
— ”বাচ্চাডি তুই ধইরা আনসস না?” একদম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন রাতুলের আম্মা।
রাতুল বড় বড় চোখে অবাক হয়ে তাকালো আম্মার দিকে, চোখাচোখি হতেই নামিয়ে নিল আবার।
— ”তোর চেক্ষের অবস্থা দেইখাই কওন যায়, তুই মিছা কতা কইতাসিস।”

রাতুলের আম্মা রাগলেন কিনা ঠিক বুঝা গেল না। কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে চলে গেলেন। রাতুল ভাবলো সে বেঁচে গেছে। তবে তার কাছে অবাক লাগলো, কীভাবে তার মা সত্যিটা এভাবে ধরে ফেললো?

রাতুল চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে ঘরের দরজার দিকে। মাত্রই তার আম্মা ঘরে ঢুকেছেন। এখনও দরজার পর্দা কাঁপছে অল্প অল্প।

|| ২ ||

ইতোমধ্যে কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে।
সুন্দর একটা ঘর বানিয়ে দেয়া হয়েছে বাচ্চাদুটোর জন্য। সুন্দর দুইটা নামও রাখা হয়েছে তাদের–ছোটু আর বটু।
ছোটু আর বটু এখন উড়তে শিখেছে পুরোপুরি। আগে অল্প অল্প পারতো, এখন ভালোই পারে। প্রতিদিন সকালে যখন রাতুল এসে তাদের খুপরির ছোট্ট দরজা খুলে দেয়, তখন এক উড়ালেই গিয়ে আমগাছটায় বসে প্রথমে। তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় সারাদিন।
সন্ধ্যাবেলার রুটিনটাও খুব সুন্দর। ছোটু আর বটু এসে বসে টিনের ঘরের চালে বাকবাকুম করতে থাকে রাতুল টের পাওয়ার আগ পর্যন্ত। ওদের ডাক শুনে রাতুল উঠোনে এলেই ডানা ঝাপটে রাতুলের দুইকাধে এসে বসে ওরা দুইজন।
রাতুল ওদেরকে চুমু খায়, বুকে চেপে ধরে। ওদের সাথে কী সব কথা বলে। আম্মার দূর থেকে দেখে হাসেন আর মনে মনে বলেন—”আচ্ছা পাগল হয়েছে ছেলেটা।”

কয়দিন পরের কথা।
সন্ধ্যা শেষে আস্তে আস্তে অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে আকাশের। ছোটু এসেছে, কিন্তু বটুর এখনো দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। রাতুল অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে উঠোনে, একটু পরপর একটা দুই ব্যাটারির টর্চ লাইটের আলো এই গাছে ওই গাছে ফেলে খুঁজোখুঁজি করছে।

একটু পর ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। ওইতো বটু! বিশেষ একটা আওয়াজে আয় আয় করে ডাকতে লাগলো রাতুল। হাতটা শূন্যে মেলে ধরলো। একটু পর বাকবাকুম শব্দ তুলে শূন্যে মেলে ধরা হাতে এসে বসলো বটু।

বটুকে যখন খুপরিতে ঢুকাতে যাবে, তখনই বিষয়টা টের পেল রাতুল। বটুর এক ডানায় তাবিজের মতো গোল করে কাগজ বাঁধা। ভয় পেয়ে গেল সে। তার সাথে বা তাদের সাথে কার এমন কী শত্রুতা, যে এসব পশুপাখি দিয়ে ঘরে তাবিজ ঢুকাতে হবে! ভয়ে ভয়ে কাগজটা খুলে নিয়ে বটুকে খুপরিতে ঢুকিয়ে দিল সে। কাগজটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে ঘরে এসে পড়ার টেবিলে বসে পড়লো।

কাগটার ভাজ খুলতেই ভয়টা কেটে গেল তার। তাবিজ-টাবিজ কিছুনা, এতে যা লেখা আছে, মোটামুটি অর্থহীনই বলা যায়। কাগজটাতে লেখা—”কে আপনি?” কাগজের ফাঁকা জায়গায় রাতুল লিখে দিলো—”আমি বটুর বড় ভাই। আপনি কে?” তারপর, কাগজটা আবার আগের মতো ভাঁজ করে তখনই বটুর পায়ে বেঁধে রেখে এলো।

পরদিন আবারো সেই গল্প।

— ”আজব তো, আপনার নাম কী সেটা জানতে চাইসি, আপনি আপনার ছোট ভাইয়ের নাম বললেন কেন?”
— “আমি রাতুল। আপনি?”
— “নদি”
— “নদি, এটা কোন নাম হলো?”
— “নাম হয়েছে বলেই তো রেখেছে। তাছাড়া, এই নামের পেছনে ছোট্ট একটা গল্প আছে–আমাদের বাড়িটা নদির তীর ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জন্ম আবার এই বাড়িতে, তাই নদি রেখেছে আমার নাম।”
— ”বাহ ভালোই তো। তাইলে তো আমার নাম শিমুল হলে ভালো হতো, আমার জন্মের সময় আমাদের বাড়ির পেছনে একটা শিমুল গাছ ছিল। সে হিসেবে…”
— “হিহি, বুঝেছি। তা, বাড়ি কোথায়?”
— “সুবর্ণপুর থাকি। আপনি?”

প্রতিদিন একটা করে প্রশ্ন, একটা করে উত্তর। এভাবে কেটে গেকো অনেকদিন। হঠাতই ছন্দ পতন। বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। বটু আর ফেরে না, উত্তরও পাওয়া যায় না কলমবন্ধুর। দিন কেটে যেতে থাকে। রাতুলের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

|| ৩ ||

পুরনো ডায়েরি থেকে—
“আমি নদি। আমার বয়স পনেরো বছর। আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমবাগান নামক একটা গ্রামে পরিবারের সাথে আমার বসবাস। পরিবারের সদস্য বলতে—আম্মা, ভাই, বোন। আব্বা মারা গেছেন আরো চার বছর আগে। তারপর থেকে চাচার ডাল-ভাতে দিন গুজরান করছি।
এইট পাশ করার পরপরই আমার চাচা সকলের অমতে মাঝ বয়সী এক লোকের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছেন। আমি এই লোকের তৃতীয় বউ। ঘরে দুই দুইটা বউ থাকার পরেও রান্নাবান্না বা কাজ করার মত কেউ নাই। সেজন্যেই আশরাফ উদ্দিন পাঠান নামক এই লোক আমাকে ঘরে তুলেছেন।

রাতদিন এই বাড়িতে আমার কাজ করেই কাটে। হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে একটু ভালো ব্যবহার পর্যন্ত জোটেনা সতীনদ্বয়ের কাছ থেকে। নীরবে চোখের জলে আঁচল ভেজাই। আমার কোনও সঙ্গি নেই। নিঃসঙ্গ জীবন এভাবেই কেটে যাচ্ছে আমার।

অনেকদিন পর বাড়িতে এলাম। সন্ধ্যাবেলায় উঠোনে একটা কবুতরকে হাঁটতে দেখে আমি সেটাকে ধরে ঘরে আনি। নেড়েচেড়ে দেখি খুব বড় না, আবার বাচ্চাও না। কবুতরটা আমার খুব পছন্দ হলো, তবে চাইলেই তো আর পাওয়া যায়না। কবুতরটা কার না কার। কে জানে?

হঠাত আমার মাথায় দুষ্টমি বুদ্ধি চেপে গেল। আমি একটা কাগজে ”কে আপনি?” লিখে কবুতরের পায়ে বেঁধে দিলাম। মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল উত্তর নিয়ে কবুতরটা আসবে ।

পরদিন আমার ধারণা সত্যি প্রমাণিত করে কবুতরটা চলে এলো। আমি আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে লাগলাম। কাগজটা খুলে দেখি ”আমি বটুর বড় ভাই, আপনি কে?” লিখা। বেশ মজা পেয়ে গেলাম আমি।

এভাবে বেশ কয়েকদিন চলার পর আমার যাওয়ার সময় চলে এলো। কলমবন্ধুর সাথে আর কথা হবে না ভেবেই আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো। কী মাথায় আসলো জানিনা, কবুতরটা যখন এলো, টুপ করে আমি তাকে জুলুঙ্গায় ভরে ফেললাম এবং সেটা নিয়ে শশুরবাড়ি চলে গেলাম।

আমি তখন খুব খোশমেজাজে আছি। মানুষ না হোক, বোবা প্রাণি হোক—সঙ্গি তো পাওয়া গেল।

কিন্তু বিধিবাম, সুখ আমার কপালে সইলো না। বড় সতীনের বেজায় শখ হলো কবুতরের মাংস ভূনা করে খাওয়ার। সেটার বলি হতে হলো আমার অদেখা কলমবন্ধুর কবুতরকে।

দুইদিন পর।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ডায়েরিতে লিখতে বসেছি। বহু পুরনো একটা ডায়েরি। আমার সামনে একটা মোম জ্বালানো।একপাতা ঘুমের অষুধ খোসা ছাড়িয়ে বাম হাতের মুঠোয় পুরেছি। ডায়েরিতে লিখা শেষ হওয়া মাত্রই আমি সেগুলো পানির সাথে মিশিয়ে গিলে ফেলবো। কেউ আমাকে আর কষ্ট দিতে পারবে না। এই অধিকার তখন তাদের আর থাকবে না। আমি ঘুমিয়ে থাকবো অনন্ত মহাকাল ধরে।”

|| ৪ ||

বটু আর ফেরেনি।
বটুর খোঁজে রাতুল এপাড়া-ওপাড়া হন্যে হয়ে খুঁজেছে, দেখা মেলেনি।
বটুর জন্য কান্না পায় রাতুলের। আবারো বুকে চেপে ধরতে খুব ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে হয়—সে তার প্রশ্ন নিয়ে যেতে পেরেছিল কিনা, বা সে কী উত্তর দিয়েছিল?
উত্তরের জন্য আগ্রহ বাড়ে, বটুর জন্য বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
বটু ফেরেনা, আর মনে হয় ফিরবেও না কোনওসময়! হয়তো আর কখনো জানা হবেনা কাঙ্খিত সেই উত্তর।

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img