জুবায়ের খান
গত কয়েকরাত তিতলুর ঘুম হয়নি । চোখের সামনে ডায়েরির সেই দিনলিপিগুলো ভাসছে । তিতলুর কাছে সবকিছু অলটপালট লাগতে থাকে । তার মনে অনেক প্রশ্ন এসে উঁকি দেয় ।
তিথি কি তাহলে আমার বোন ?
সে কোথায় এখন ?
তাহলে আমার বাবা মা কি আমার বাবা মা না ?
তিতলু এই রুম থেকে ঐ রুম পায়চারি করতে থাকে । রেজাউল ইসলাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। তিতলুর পাইচারি পত্রিকাতে তার মনযোগ ভেঙেছে ।
কিরে ? কি হলো তোর ?
তিতলু বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, কিছুনা ।
আগামীকাল তিতলুর স্কুল খোলা । পরীক্ষার ছুটি আজ শেষ হয়েছে । রাকিবের সাথে তিতলুর বহুদিন কথা হয়না । অনেক কথা তার জমা পড়ে আছে যা তিতলু রাকিব কে বলতে চায় ।
তিতলু পরদিন যথাসময়ে ক্লাসে উপস্থিত হলো । কিন্তু সে রাকিবের দেখা পেলো না । রাকিব স্কুলের নিয়মিত ছাত্র । মাসে একদিন বন্ধ দিলেই রাকিব উন্মাদের মত আচরণ করতে থাকে । আজ সে আসেনি । তিতলু রাকিবের জন্য ক্লাসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো কিন্তু রাকিবের দেখা পেলো না । এভাবে টানা তিন দিন স্কুলে রাকিবের অনুপস্থিতি তিতলুকে ভাবিয়ে তুলেছে । ক্লাস টিচারও সেদিন তিতলুকে জিজ্ঞাস করেছে রাকিবের কথা । তিতলু কোনো উত্তর দিতে পারে নি । তিতলু সিদ্ধান্ত নিল স্কুল ছুটির পর রাকিবের বাসায় যাবে ।
তিতলু রাকিবের বাসার পথে হাঁটতে থাকে । দেয়ালের সেদিন তিততি লেখাগুলো হালকা হয়ে গেছে । কয়েকদিন পর হয়তো মুছে যাবে । তিতলুর ইচ্ছে হচ্ছে ইট দিয়ে তাতে ওভাররাইটিং করে দিতে কিন্তু ব্যাপারটা অনেক বাচ্চামো বলে তার মনে হলো । তিতলু রাকিবের বাসার দরজার সামনে এসে কলিংবেলের সুইচে চাপ দিল ।
টিং টিং
তিতলু তুই ?
রাকিব দরজার ঐ পাশ থেকে জিজ্ঞাস করলো, চোখেমুখে তার অবিশ্বাসের ছাপ । রাকিবের চাহুনি দেখে মনে হবে যেন তিতলু তার বাসায় আসতে পারে তা সে কল্পনাও করতে পারেনা । তিতলু অপ্রস্তুতভাবে উত্তর দিল, হ্যা আমি । ভিতরে আসি ?
সরি রে । খেয়াল ছিল না । হ্যা ভিতরে আয় ।
তিতলু রাকিবের রুমে গিয়ে বসলো । তিতলু রাকিবের বাসায় শেষবার এসেছে রাকিবের জন্মদিনের দিন । কিন্তু এখন তার কাছে বাসাটি অপরিচিত বলে মনে হচ্ছে । রুমগুলোতে কেমন যেন শূন্যতা বিরাজ করে আছে । আসবাবপত্রের সল্পতা পরিষ্কারভাবে তিতলুর চোখে ধরা দিয়েছে ।
খাবি কিছু ?
তিতলু রাকিবের এরকম প্রশ্ন শুনে ভীষণ অবাক হলো । রুমগুলোর সাথে সাথে রাকিবের ব্যবহারেও পরিবর্তন ঘটেছে । আগে রাকিব কেউ খাবে কিনা জিজ্ঞাস করতো না । অনেকগুলো খাবার ও তার রম্য দিনলিপি এনে সে আড্ডার আসর জমাতো । তিতলু তার অবস্থান থেকে একটু সরে বসে বললো, বস এখানে । কি হয়েছে বল তো ?
রাকিব তিতলুর প্রশ্ন শুনে অবাক হলো না কিন্তু তার চোখে অশ্রু জমেছে তা পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করলো তিতলু । তিতলু অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো, কিরে কাঁদিস কেন ? বল কি হয়েছে ?
রাকিব হাত দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে নিল । কোনো কথা না বলে সে রুম থেকে চলে গেল । তিতলুর কাছে সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছে । সে কি চুপচাপ বসে থাকবে না উঠে দেখবে রাকিব কোথায় গেল ভাবতে ভাবতে রাকিব রুমে এসে হাজির হলো । রোমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বিছানায় বসলো । রাকিব বড় একটা নি:শ্বাস নিয়ে বললো, আম্মা !
আম্মা ? আন্টির কি হয়েছে ?
আম্মার ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছে ।
বলিস কি ? কোথায় আন্টি এখন ?
আম্মা এলাকার পাশে ছোট্ট একটা হাসপাতালে ভর্তি আছেন ।
আপুরা কই ?
রিয়া আপু মায়ের সাথে হাসপাতালে আছেন । রিতুটা স্কুলে গেছে ।
তিতলু কিছু বলার প্রসঙ্গ খুজে পেলনা । রাকিব কিছুক্ষন থেমে বললো, আম্মার জরুরি অপারেশন প্রয়োজন । কিন্তু তার জন্য অনেক টাকা দরকার । মামাদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে তারা বলেছেন সাহায্য করবেন । কিন্তু তাঁদের কাছে গেলে বলেন পাগল হয়ে গেছি আমরা টাকার জন্য । অপারেশন হয়ে নিক, টাকা দিবে তারা ।
তো আন্টির অপারেশন করতে বল ?
আম্মা এখন যেখানে ভর্তি আছেন সেটাতে এই ধরণের অপারেশন করানো হয়না । আম্মাকে বড় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে । তবে অপারেশনের জন্য এডভান্সড কিছু টাকা হাসপাতালে দিতে হবে । সেই টাকা জোগাড় করতে গিয়েই…
রাকিব মাথা তুলে রুমের দিকে চেয়ে রইলো ।
চলবে…