মহিবুল ইসলাম বাঁধন ||
বাংলা সাহিত্যের উজ্বল নক্ষত্র বিভূতিভূষণের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চব্বিশ পরগনার ঘোষপাড়া মুরাতিপুরে। বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুটা দার্শনিক আর উদাসীন থাকায় বিভূতিভূষণের ছোটবেলা কেটেছে বড্ড কষ্টে। শত বাধা সত্ত্বেও বনগাঁও স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯১৬ সালে আইএ এবং ১৯১৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই পিতৃহারা হলে অন্য বাড়িতে লজিং থেকে খুব কষ্টে দিন যাপন করতে হয় তার।
জীবনের বিচিত্র ঘটনা গুলোই তিনি তার রচনায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। নিজের জীবনের কষ্টকর স্মৃতিগুলোর একটা রূপ দেখতে পাওয়া যায় পথের পাঁচালীর অপুর মধ্যে। মা মৃণালিনী দেবীকেই তিনি সর্বজয়া রূপ দিয়েছেন। দুর্গা চরিত্রটি ছিল কাল্পনিক। যদিও বিভূতিভূষণের ছোট এক বোন ছিল, যে অল্পবয়সেই মারা যায়।
ছাত্র অবস্থাতেই তিনি বিয়ে করেন বসিরহাটের গৌরী দেবীকে। কিন্তু এক বছরের মাথায় গৌরী মারা যায়। আর সেই কাহিনীই বিভূতি তুলে ধরেছেন তার বিখ্যাত ‘অপরাজিতা ‘ উপন্যাসে।
বিএ পাশ করার পর বিভূতিভূষণ লেখাপড়া ছেড়ে দেন। জড়িয়ে পরেন নানা পেশায়। চাকরির অংশ হিসেবে ছুটে বেড়ান পূর্ব বাংলার নানা জেলায়। সেসব এলাকার ভ্রমণের বিচিত্র কাহিনী উঠে এসেছে তার ‘অভিযাত্রিক’ বইতে।
এরপর হুগলির স্কুল এ কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। অল্পকিছুদিন পরেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেরেত ঘোষের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে ভাগলপুরে জমিদারি দেখাশোনা করে। বিহারের দরিদ্র মানুষদের নিয়ে তিনি লেখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ আরন্যক’।
সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৪২ সালে তিনি বিয়ে করেন ফরিদপুরের রমা দেবীকে। তার সন্তান তারাদাস এর জন্ম হয়। বিহারের ঘাটশিলার প্রেমে পড়ে সেখানে একটি বাড়ি কিনেন। কিন্তু ১৯৫০ এ আকস্মিক মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু।
বিচিত্র সব সাহিত্য রচনা করে তিনি বাঙালির হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। অপু দুর্গা কিংবা সর্বজয়ার মতো অবিশ্বাস্য সব চরিত্র কিংবা ইন্দির ঠাকুরুনের মতো পিসিমা। বাংলা কিংবা ভারতবর্ষের বাইরে পা না দিয়েও আফ্রিকার জঙ্গল, মরুভূমি কিংবা রিখটারসভেল্ড পর্বতে অভিযান যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা অবিশ্বাস্য। প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় প্রেম, সঙ্গে নীলকর আর জমিদারদের শোষণের এক আশ্চর্য চিত্র ‘ইছামতীর বাঁকে’ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। আর এই উপন্যাসের মধ্য দিয়েই তিনি পেয়েছেন জীবনের একমাত্র পুরস্কার মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার।
সাহিত্যের রং তুলিতে প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা মহান শিল্পীর প্রতি চির বিনম্র শ্রদ্ধা।