জাকিয়া সুলতানা প্রীতি ||
প্রিয়তমা মিলি,
একটা চুম্বন তোমার পাওনা রয়ে গেলো। সকালে প্যারেডে যাবার আগে তোমাকে চুমু খেয়ে বের না হলে, আমার দিন ভালো যায় না। আজ তোমাকে চুমু খাওয়া হয়নি। আজকের দিনটা
কেমন যাবে জানি না… এই চিঠি যখন তুমি পড়ছো, আমি তখন তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। ঠিক কতোটা দূরে আমি জানি না।
মিলি, তোমার কি আমাদের বাসর রাতের কথা মনে আছে? কিছুই বুঝে উঠার আগে বিয়েটা হয়ে গেলো। বাসর রাতে তুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যখন কাঁদছিলে, আমি তখন তোমার হাতে একটা
কাঠের বাক্স ধরিয়ে দিলাম। তুমি বাক্সটা খুললে… সাথে সাথে বাক্স থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকী বের হয়ে সারা ঘরময় ছড়িয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো আমাদের ঘরটা একটা আকাশ…আর জোনাকীরা তারার ফুল ফুটিয়েছে!
কান্না থামিয়ে তুমি অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, “আপনি এতো পাগল কেনো?”
মিলি, আমি আসলেই পাগল… নইলে তোমাদের
এভাবে রেখে যেতে পারতাম না।
মিলি, আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন প্রিয় কন্যা মাহিনের জন্মের দিনটা। তুমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলে। বাইরে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি… আমি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কষ্টে পুড়ে যাচ্ছি।
অনেকক্ষণ পরে প্রিয় কন্যার আরাধ্য কান্নার শব্দ… আমার হাতের মুঠোয় প্রিয় কন্যার হাত! এরপর আমাদের সংসারে এলো
আরেকটি ছোট্ট পরী তুহিন…. মিলি, তুমি কি জানো… আমি যখন আমার প্রিয় কলিজার টুকরো দুই কন্যাকে এক সাথে দোলনায় দোল খেতে দেখি, আমার সমস্ত কষ্ট – সমস্ত যন্ত্রণা উবে
যায়। তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো, আমার কন্যাদের শরীরে আমার শরীরের সূক্ষ্ম একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়? মিলি…
আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আমার কন্যারা যদি কখনো জিজ্ঞেস করে, “বাবা কেনো আমাদের ফেলে চলে গেছে?”
তুমি তাঁদের বলবে,
“তোমাদের বাবা তোমাদের অন্য এক মা’র টানে চলে গেছে… যে মা’কে তোমরা কখনো দেখো নি। সে মা’র নাম ‘বাংলাদেশ’; মিলি… আমি দেশের ডাককে উপেক্ষা করতে পারি নি। আমি দেশের জন্যে ছুটে না গেলে আমার মানব জন্মের
নামে সত্যিই কলঙ্ক হবে। আমি তোমাদের যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাকে জন্ম দেওয়া দেশটাকে। যে দেশের প্রতিটা ধূলিকণা আমার চেনা। আমি জানি… সে দেশের নদীর স্রোত কেমন… একটি পুটি মাছের হৃৎপিন্ড কতটা লাল, ধানক্ষেতে বাতাস কিভাবে দোল খেয়ে যায়….!
এই দেশটাকে হানাদারের গিলে খাবে, এটা আমি কি করে মেনে নিই? আমার মায়ের আচল শত্রুরা ছিঁড়ে নেবে… এটা আমি সহ্য করি কিভাবে মিলি? আমি আবার ফিরবো মিলি… আমাদের
স্বাধীনদেশের পতাকা বুক পকেটে নিয়ে ফিরবো। আমি, তুমি, মাহিন ও তুহিন… বিজয়ের দিনে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াবো সবাই। তোমাদের ছেড়ে যেতে বুকের বামপাশে প্রচন্ড
ব্যথা হচ্ছে… আমার মানিব্যাগে আমাদের পরিবারের ছবিটা উজ্জ্বল আছে… বেশি কষ্ট হলে খুলে দেখবো বারবার।
ভালো থেকো মিলি… ফের দেখা হবে। আমার দুই নয়ণের মনিকে অনেক অনেক আদর।
ইতি,
মতিউর।
২০ আগস্ট, রোজ শুক্রবার, ১৯৭১
হ্যা, এটাই বাংলার সূর্যসন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের তার প্রিয়তমা স্ত্রী মিলি কে লিখা শেষ চিঠি।।
২০ আগস্ট ১৯৭১||
করাচি বিমানবন্দরের মৌরিপুর বিমান ঘাটি।।
বাংলার স্বাধীনতা কামী, মুক্তিপাগল পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অন্যতম মেধাবী ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান, তার ই ছাত্র মিনহাজ রশিদের কাছ থেকে একটি জঙ্গিবিমান ছিনতাই করে পালিয়ে যেতে থাকে।
শুরুর দিকে মিনহাজ বেপার টা বুঝতে না পারলেও কিছুক্ষণ পরেই বুঝে ফেলে বিমান ছিনতাই হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ সে অডিও বার্তায় কন্ট্রোল রুমকে জানিয়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় ধস্তাধস্তি, এক পর্যায়ে মিনহাজ জ্ঞান হারায়।
মতিউর উড়ে যেতে থাকে ভারতীয় সীমানার দিকে।ততক্ষণে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ৪ টি জঙ্গি বিমান ধাওয়া করে মতিউরের বিমান কে।।
রাডারের চোখ এড়াতে মতিউর বিমান টিকে নির্দিষ্ট উচ্চতার অনেক কম উচ্চতা দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়। ততক্ষণে মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে।
সে বিমানের ইনজেক্ট সুইচ চেপে দেয়।
অল্প উচ্চতায় উড়তে থাকা বিমান টিকে হঠাৎ একটা কড়া ব্রেক কষে দেওয়ার মত হয়ে যায়।।
পরক্ষণেই বিধ্বস্ত হয় বিমান টি।।
ভারতীয় সীমানা মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে তখন, মাত্র ৩ মিনিটের পথ।
প্যারাসুট না থাকায় ছিটকে পরল মতিউর।।
অদম্য সাহসী এক বীর সেনানীর স্বাধীন বাংলার পতাকা বুক পকেটে নিয়ে আর ফেরা হলো না মিলির কাছে।।
এ ঘটনায় পাকিস্তান সরকার মিনহাজ কে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করে। তার নামে বিমান ঘাটি করা হয়। নাম করণ করা হয় অসংখ্য রাস্তার। আর আধা মাইল দূরে ছিটকে পরা, পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সবচেয়ে মেধাবী অফিসার, ক্ষতবিক্ষত মতিউরের লাশ দাফন করা হয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী দের কবরস্থানে। দেশ স্বাধীনের পর মতিউর কে দেওয়া হয় বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব।।
আজ এই মহান মানুষ টির মৃত্যুবার্ষিকী।
কতটা নিভৃতে চলে যায় এই ২০ আগস্ট।।
অথচ এমন ২০ আগস্ট না থাকলে হয়ত স্বাধীন দেশে বুক ভরে নিঃশ্বাস টা পর্যন্ত নিতে পারতাম না!!
মতিউররা মরে না।
ওদের মৃত্যু নেই।
ওরে চুপিচুপি আসবে।। বাংলার মা পরম যত্নে ধারণ করে আছেন তার বীর সন্তান দের। প্রতি জ্যোৎস্না রাতে পরম মমতায় সন্তানহারা এ মাটি বলে উঠে আহা রে আহা রে!