Tuesday, July 29, 2025
27.1 C
Dhaka

একটি নি:শব্দ কথন

 

‘নিঃশব্দ’ গুচ্ছ সমাজের হৃদয়স্পর্শী গল্প।

প্রতিনিয়ত স্বপ্নের স্থলন হয়, আমরা কেউই জানিনা আগামিকাল কি ঘটবে। কেউ হটাত করে মরে যেতেই পারে, সেই ঘা’ও শুকিয়েও যায় মাসের ব্যবধানে। কিন্তু ইচ্ছে অনিচ্ছায় শতবছরের ভিটেমাটিকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টটা বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন, এটা একধরনের পাপ বৈকি। তবে সব পাপের আবার শাস্তি নেই। কিছু কিছু পাপ সংগঠিত হয় শান্তির জন্য, তেমনই শান্তি আর অশান্তির গল্পকে সাহিত্যের নিখাঁদ সেলাইতে বুনে এক করেই ‘নিঃশব্দ’ লিখেছেন তরুণ লেখক সাইফুদ্দিন রাজিব।

লেখকের প্রতি পাঠকের বিশ্বাস তৈরি হয় তার লেখা পড়ে, যেটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু লেখকের যখন প্রথম প্রকাশ, তখন হয় যত চিন্তা। দীর্ঘ উপন্যাসটি প্রচারে লেখক বা প্রকাশকের পক্ষে দু-একশ শব্দে তুলে ধরা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কাহিনীর ভেতরের গল্পগুলো তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব বলেই অঙ্কুরে হারিয়ে যায় কিছু লেখক আর তার সমৃদ্ধ সেই সৃষ্টি। তবে নিঃশব্দ উপন্যাসটি পাঠক আপন বিশ্বাসে খুঁজে নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ উপন্যাসটির চিত্র বা প্লটকে আমার একটা বটবৃক্ষ মনে হয়েছে। আশির দশকের শেষের এই সামাজিক চিত্রকে তুলে আনতে লেখক যে রীতিমত মাঠে নেমে গবেষণা করেছেন বইটির সামগ্রিক চিত্রে তাই দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।

নিঃশব্দ উপন্যাসটা হাতে নেবার সাথে সাথে সবথেকে আকর্শনীয় বিষয় বইটির প্রচ্ছদ ও নামকরণ। উপন্যাসটা শেষ করে আবার ফিরে আসতে হয় লেখক আর প্রচ্ছদশিল্পী কতটা সার্থক ঠিক এই জায়গায়। গল্পের কাহিনীই যেন ফুটে উঠেছে এই দুই দৃশ্যপটে। প্রচ্ছদে স্থান পাওয়া নিঃশব্দ নামের সাথে একটা শিশুর অবয়ব। আক্ষরিক অর্থেই মনে হয় কাহিনীর মুল চরিত্র এই ছোট শিশু অপু, পরবর্তিতে দুরারোগ্য ব্যাধি ‘হাইপোগ্লোসাল নিউরাইটিসে’ আক্রান্ত হয়ে শিশুটি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। সুতারং সে অর্থে নামকরণের একটা সার্থকতা ছিল ঠিকই কিন্তু তারপরেও লেখক সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেননি। পুরো বইটির প্রতি পরিচ্ছেদে সামাজিক বার্তা ছড়িয়েছেন যা পাঠক হিসাবে আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি, সামাজিক-পারিবারিক দায়বদ্ধতা, কুসংস্কার, জাত-পাত ভেঙে চুরে লেখক কলম চালিয়েছেন বেশ দৃঢ়ভাবে। দায়িত্ববোধের গভীর নিদর্শন দেখিয়েছেন উপন্যাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান চরিত্র সোমনাথ ও ভারতী দেবী।
যুগপৎ ভাবে বর্ণনা করা উপন্যাসের মুল চরিত্র মুসলিম মা হিন্দু বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া ছোট শিশু অপু। সামাজিক বিভীষিকার শিকার হয়ে স্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেলে শিতের রাতে আট মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে কলাগাছের ভেলায় ইছামতী নদী পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যেতে বাধ্য হয় সরকারী কর্মকর্তা সোমনাথ। বাগেরহাটের মোজাফফর সরদারের পরিবারকে দুইহাতে টেনে তুলেছিলেন সৌমেন বিশ্বাস ও পরের দিকে সোমনাথ বিশ্বাস। অথচ সেই পরিবারের সন্তানের নির্যাতনের শিকার হয়ে শুধুমাত্র শিশুসন্তানটিকে বাঁচাতেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় সোমনাথ।

উপন্যাসে পরের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভারতী দেবী। দারিদ্রতার করাল অক্টোপাসে বেঁধে থাকা এই বিধবা নারী দেখিয়েছেন দায়িত্বশীলতা আর মমত্ববোধের সর্বোচ্চ নিদর্শন, সেটা কখনো নিজ ভাই অথবা ভ্রাতাস্পুত্র পরশ এবং পরবর্তীতে শিশু সন্তান অপুর প্রতি। আজীবন দুঃখ বয়ে বেড়ালেও ব্যক্তিগত কষ্ট যখন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল তখনই অসুস্থ অপুকে কোলকাতার হাসপাতালে বাকশক্তি হারাতে দেখে শোক সামলে উঠতে পারেননি। সকল নির্মমতাকে জয় করা ভারতী দেবী নিজেই পৃথিবী নিঃশব্দে। উপন্যাসটির এই সময়ে এসে কোন পাঠকের শরীর হিম হয়ে আসবে। থমকে যাবে চোখের পলক। লেখক হিসাবে সাইফুদ্দিন রাজিবকে খুবই নির্দয় মনে হয়েছে ভারতী দেবীর এই ঘটনায়। তবে সব দৃশ্যপট বদলাতে থাকে তার মৃত্যুর পরে, পদে পদে কষ্ট সইতে হয় ভারতী দেবী ও নিখোঁজ বাবাকে খুঁজে ফেরা শিশু সন্তান অপুকে। মুখে মুখে অপয়া বনে গেলেও মুদ্রার উল্টো পিঠে তাকে বুকে আগলে রাখার মত কিছু মানুষ থেকেই যায়। লেখককে এখানে সার্থক মনে হয়েছে, তিনি যেমন সামাজিক কুসংস্কার দেখিয়েছেন একইভাবে বোধের বিপরীত দিকও দেখিয়েছেন তার লেখনশৈলীতে।

গল্পের অন্য পিঠে লেখক দেখিয়েছেন দুই স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে মোজাফফর সরদারের সংসার। মমত্ববোধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার গুচ্ছ নিদর্শন ‘নিঃশব্দ’ উপন্যাসটি যে একটা দারুণ বটবৃক্ষ তার প্রমান মোজাফফর সরদারের পরিবার। সেখানে সামান্য পাণ বানানোতে যেমন রহিমা বেগম স্বামীর ভালবাসা খুঁজে পান তেমনি সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছোট স্ত্রী নূরানি বেগম পেয়েছিলেন আকিবের মত ছোট্ট শিশুও। পারিবারিক ভালবাসায় কতটা ডালপালা ছড়াতে পারে লেখক সেটা গভীর ভাবে তুলেছেন নিঃশব্দের দৃশ্যপটে। মোজাফফর সরদারের চেয়ারম্যান হবার পরে সমাজের প্রতি নিবিড় দায়বদ্ধতার নিদর্শন হতে পারে যে কোন নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরও। সাইফুদ্দিন রাজিব দেখিয়েছেন কীভাবে সুচারুরূপে ন্যায় অন্যায়কে আলাদা করা যায়।

ব্যক্তিগত অভিমত হল ঔপন্যাসিক হিসাবে সাইফুদ্দিন রাজিব কতটা সফল হবেন সেটা হয়ত সময়েই জানা যাবে। তবে নিঃশব্দ উপন্যাস পড়ে যে কোন পাঠকই অপেক্ষা করবেন তার পরবর্তি সৃষ্টির জন্যে। লেখকের একটা বিষয় আমার কাছে চোখে পড়েছে তা হল ভাষাগত স্থলন। চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিকতা এনেছেন হয়ত, কিন্তু বর্ণনায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষার মিশেল লক্ষ্য করেছি। যদিও উপন্যাসটি দুই অঞ্চলের পট নিয়ে তৈরি। তবে তার সাবলীল বর্ণনায় লেখককে নতুন মনে হয়নি। এক কথায় বললে, ‘নিঃশব্দ’ সামাজিক বার্তায় ভরপুর একটি উপন্যাস।

*বইতথ্য :

বইয়ের নামঃ নিঃশব্দ।
লেখকঃ সাইফুদ্দিন রাজিব
প্রকাশকঃ নালন্দা প্রকাশনী
পৃষ্ঠাঃ ২৫৮
মুদ্রিত মুল্যঃ ৪৫০ টাকা।

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

আজ “পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস” আর একটি শিশুর প্রাণও যেন হারিয়ে না যায়

বদরুল ইসলাম (বরগুনা) আজ ২৫ জুলাই—বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ...

আলেমদের গালি দেওয়া নয়, সম্মান করাই আমাদের করণীয়

বদরুল ইসলাম যে জাতি আলেমদের অবমাননা করে, তারা ধ্বংস হয়ে...

আগুনে পুড়ে মৃত্যু: শাহাদাতের মর্যাদা

বদরুল ইসলাম (বরগুনা) আমরা প্রায়ই খবরের কাগজে, টেলিভিশনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়...

বরগুনায় ডেঙ্গুতে আরও এক নারীর মৃত্যু, আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ৪ হাজার

বদরুল ইসলাম (বরগুনা) বরগুনা জেলার ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন আরও...

স্বামীকে হত্যা করে বাড়ির উঠানে পুঁতে রাখলেন স্ত্রী, আসামে চাঞ্চল্য

ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটিতে এক নারীর হাতে স্বামী হত্যার...

সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করা হোক: একটি বাস্তবমুখী ও মানবিক দাবি

বদরুল ইসলাম বাংলাদেশের কোটি কোটি তরুণ শিক্ষিত হচ্ছেন, স্বপ্ন দেখছেন...

গাজায় পানির খোঁজে গিয়ে ৬ শিশুসহ ১০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করল ইসরায়েল

গাজায় পানির তীব্র সংকটের মধ্যেও থেমে নেই ইসরায়েলের হামলা।...

সাভারে মাদকের ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ, ছুরিকাঘাতে শিশু হত্যা

ঢাকার সাভারে মাদক সেবনের সময় ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img