Tuesday, July 29, 2025
27.1 C
Dhaka

আমি মুক্তি চাই

– আরহাব রহমান আমীরুল ||

সরকারি কর্মকর্তা আরহাব সাহেব। ঢাকায় ভালো একটি পোস্টে আছেন তিনি।ব্যক্তিগত দিক থেকে তিনি বেশ সৎ এবং নিষ্ঠাবান ।বিয়ের ১৭ পেরিয়ে গেলেও ভাগ্যের পরিহাসে আজও বাবা ডাক শুনতে পারেননি । গ্রামের বাড়িতে যান না বেশ কয়েক দিন,এইতো বছর দশেক হলো। সরকারি কাজ করার সুবাদে তেমন একটা ছুটিও পাননা তিনি।অনেক বছর পর মনে পড়ল, গ্রামের বাড়ি যাওয়া দরকার।ইটপাথর ও কংক্রিটে মোড়ানো মায়ার শহরে কেমন যেন একঘেয়েমি চলে এসেছে তার সঙ্গিনীরও।

অফিস শেষে রাত করে বাসায় ফেরার পর মায়া জড়ানো কন্ঠে স্ত্রীর ডাক।

-ওগো শুনছো, অনেক দিন হলো গ্রামের মুখপথ হইনা।চলো না, একটু গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।

-কি যে বলো তুমি।আমি কাজের জন্য ঠিকমত হাঁফ ছেড়ে দাঁড়াতে পারছিনা, আর তুমি আছো তোমার ঘুরা নিয়ে।

-শুধু কাজ কাজ আর কাজ! ভাল্লাগেনা আর এইসব।আমি এতকিছু জানিনা।তুমি এবার ছুটি নিয়ে আমাকে গ্রামে নিয়ে যাবে। ব্যাস!

-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে তো! আমি ছুটি নিবো।এবার খুশি?

-নাহ! যতোক্ষন না আমি গ্রামে যাচ্ছি ততক্ষন আমি শান্তি পাবো না।

জীবনে প্রথম বারের মতো আরহাব সাহেব অফিসে ছুটি চাইলেন। ছুটি মঞ্জুর না করে থাকতে পারলেন না তার স্যার।

পারিবারিক দিক থেকে আরহাব সাহেবরা জমিদার বংশধর। তার দাদা ছিলেন সেই আমলের জমিদার। বাপ-দাদা আর কেউ বেচেঁ নেই। তাই বাড়ি খালিই পরে থাকে। একজন কেয়ার টেকার আছে অবশ্য। নাম গণেশ পাল।দীর্ঘ অনেক বছর ধরেই গণেশ বাড়ি পাহারা দিয়ে এসেছে।আরহাব সাহেব আসবে শুনে গণেশর খুশির সীমানা আর রইলোনা। ভৌতিক রূপ নেয়া বাড়িটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে যেন প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। বেশ দূরের পথ হওয়ায় গ্রামে আসতে আসতে তাদের রাত হয়ে গেলো।

রাত বারোটা নাগাদ ঝিঁঝিপোকার ব্যস্ততা ভেঙে শোনা গেল গাড়ির শব্দ। শব্দ শুনে গণেশ এগিয়ে আসলো। গাড়ি থেকে মালপত্র সব নামিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলো। গ্রামে বিদ্যুৎ সুবিধা নেই বললেই চলে। বাড়ির চারপাশ মশাল দিয়ে আলোকিত হয়ে আছে।ঘরের জন্য লন্ঠন এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতের খাবার শেষ করে একটু পুকুরের পাড়ে এসে বসলেন আরহাব সাহেব, চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন কিন্তু চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে পুকুরটা জ্বলজ্বল করছে।

-গণেশ, অনেক দিন ধরে হুকায় টান দেইনা।
-আজ্ঞে দাদাবাবু আমি কি তাহলে হুকার ব্যাবস্থা করবো?
-তা আর বলতে! করে ফেলো!

খানিকক্ষণ পর গণেশ হুকার কয়লায় ফুঁ দিতে দিতে হাজির। হুকাটা আরহাব সাহেবকে দিলেন।হুকায় খেতে খেতে বললেন;

-গণেশ, আমাদের রাজবাড়ী নিয়ে অনেক মানুষ অনেক কথা বলে।এখানে নাকি রাতে কিসের চিৎকার শোনা যায়।
-জ্বী দাদাবাবু মানুষ বলে।কিন্তু আমি কোনোদিন দেখিনি বা শুনিনি।তবে মানুষরা যাকে দেখে তার সম্পর্কে আমি জানি।
-মানে? (কৌতূহলী ভাবে) কাকে দেখে? এবং তুমিই বা কি জানো তার সম্পর্কে? বলো
-আচ্ছা শুনুন তাহলে, সময়টা ছিলো আপনার দাদা যখন জমিদার ছিলেন।আপনার দাদা খুব কঠিন মানুষ ছিলেন।এই গ্রামেই একটি পরিবার থাকতো নিতেন দত্ত্ব ও তার সঙ্গিনী এবং তাদের একটি মেয়ে নাম লক্ষ্মী। বয়স তখন ছিলো পনেরো এর এপার ওপার। মরন ব্যাধি বসন্ত রোগে লক্ষ্মীর মা-বাবা মারা যান।লক্ষ্মীরও শরীরে গুটি গুটি কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল। লক্ষ্মীর বাবা-মার সৎকার অনেক কষ্টে করা হয়।কেননা তাদের কোনো পরিবারের কেউ নেই এই এক মেয়ে ছাড়া।

(হুকার কয়লা নিভে যাওয়ায় গণেশ)
-দাদাবাবু দিন কয়লাটা ধরিয়ে দেই।

-থাক থাক লাগবে না,তুমি বলো।

(আবার গণেশ বলতে শুরু করলো)
মেয়েটা একদম একা হয়ে গেলো।ঘরে কোনো খাবার ছিলোনা কেউ লক্ষ্মীকে খাবারতো দূরে থাক ওর দিকে তাকায়ওনা কেননা তারা মনে করেছিলো তাদের দিকেও বসন্ত আঘাতহানবে।লক্ষ্মী নিরুপায় হয়ে চুরি করতে বাধ্য হলো এবং সে ধরা খেলো।আপনার দাদার কাছে নিয়ে এতো গ্রামের মানুষ সব কিছু খুলে বললো।আপনার দাদা মেয়েকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে উল্টো লক্ষ্মীকে ঘর বন্দি করে রাখার জন্য অনুমতি দিলেন।লক্ষ্মীকে একটি অন্ধকার ঘরে আটকিয়ে রাখা হলো।খাবার ঠিক মতো দিতো না। কেননা তাদের উদ্দেশ্য ছিলো লক্ষ্মী যেন মারা যায়।ও যত তারাতারি মারা যাবে গ্রাম তত তারাতারি অভিশাপ মুক্ত হবে।আপনার জমিদার সাহেব কিন্তু লক্ষ্মীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ভালো করতে পারতেন কারণ তখনো লক্ষ্মীর গায়ে তেমন বসন্ত হয়নি। লক্ষ্মী প্রতিনিয়ত চিৎকার করে বলতেন “আমাকে ছেড়ে দাও।আমি মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।”কিন্তু কারো মন বিন্দু পরিমাণও দমেনি। কিছুদিন পর আর ওই ঘর থেকে কোনো শব্দ আসেনা।ঘর খুলে দেখে লক্ষ্মী আর জীবিত নেই।ঘরের প্রতিটি যায়গায় লেখা “আমি মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।”পরে মেয়েটিকে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিলো।আর তারপর থেকেই এই বাড়ি থেকে লক্ষ্মীর চিৎকার শোনা যায়।

গল্প বলা শেষ করলো গণেশ। চারপাশে নিস্তব্ধতা যেন আরও ঘন হয়ে উঠলো, ঝিঁঝিরাও চুপ হয়ে গেছে। হঠাৎ কি যেন শোনা গেল দূর থেকে,নির্জনতা ভেদ করে বুক চিড়ে প্রবেশ করলো আর্তনাদ টা।

“আমাকে ছেড়ে দাও।আমি মুক্তি চাই, মুক্তি চাই”

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

আজ “পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস” আর একটি শিশুর প্রাণও যেন হারিয়ে না যায়

বদরুল ইসলাম (বরগুনা) আজ ২৫ জুলাই—বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ...

আলেমদের গালি দেওয়া নয়, সম্মান করাই আমাদের করণীয়

বদরুল ইসলাম যে জাতি আলেমদের অবমাননা করে, তারা ধ্বংস হয়ে...

আগুনে পুড়ে মৃত্যু: শাহাদাতের মর্যাদা

বদরুল ইসলাম (বরগুনা) আমরা প্রায়ই খবরের কাগজে, টেলিভিশনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়...

বরগুনায় ডেঙ্গুতে আরও এক নারীর মৃত্যু, আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ৪ হাজার

বদরুল ইসলাম (বরগুনা) বরগুনা জেলার ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন আরও...

স্বামীকে হত্যা করে বাড়ির উঠানে পুঁতে রাখলেন স্ত্রী, আসামে চাঞ্চল্য

ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটিতে এক নারীর হাতে স্বামী হত্যার...

সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করা হোক: একটি বাস্তবমুখী ও মানবিক দাবি

বদরুল ইসলাম বাংলাদেশের কোটি কোটি তরুণ শিক্ষিত হচ্ছেন, স্বপ্ন দেখছেন...

গাজায় পানির খোঁজে গিয়ে ৬ শিশুসহ ১০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করল ইসরায়েল

গাজায় পানির তীব্র সংকটের মধ্যেও থেমে নেই ইসরায়েলের হামলা।...

সাভারে মাদকের ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ, ছুরিকাঘাতে শিশু হত্যা

ঢাকার সাভারে মাদক সেবনের সময় ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img