-সৈকত হাসান
দক্ষিণের দুতালা বিল্ডিংটা আমার কাকাদের। আজকে ২ বছর হল উপর তালা খালি পরে আছে। ভাড়াটিয়া আসলে ঠিক দুই কি তিন মাসের বেশি টিকেনা। কাকা দেশের বাহিরে থাকায় আর তার কোন ছেলে সন্তান নাই বলে বাড়ির দেখা শোনার ভারটা আমার কাধেঁই আপাতত বলা চলে। সকালে কাকিমা খবর দিল নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে রুম দেখতে, আমি রুম দেখাতে নিয়ে গেলাম এবং ব্রু কুচকে যাওয়া লোকটি সম্মতি জানিয়েছে রুম তার পছন্দ হয়েছে। জানিয়ে গেছেন সবকিছু ঠিক থাকলে পরবর্তী মাসের প্রথম দিন থেকেই তারা দুতালার ডান পাশের রুমটা দখল করবে। জুলাই মাসের এক তারিখ, দুতালায় নতুন ভাড়াটিয়ার আগমন। আসবাবপত্র নামানোয় আমিও তাদেরকে সহযোগিতা করলাম। জুলাই মাসের দশ তারিখ, উত্তরের টিনের ছাউনি ঘেরা ছোট্ট ঘরটা আমার, কাকারাই তোলে দিয়েছেন থাকার জন্য। বিকেল বেলা হাতে সুনিলের বই নিয়ে বসেছি, আবৃত্তি করি, আবৃত্তিটা খুব ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দের। বলে রাখা ভালো আমার জানালা দিয়ে দক্ষিনের বাতাস, কাকিদের বিল্ডিং, একটু সামনে তাকাতেই প্রতিদিন সুরের আড্ডা দেখা যায়। আজকে দেখলাম ভিন্ন জিনিস, কাকিদের বিল্ডিংয়ের নতুন ভাড়াটিয়ার একটা মেয়ে আছে, তাকেও ঠিক দেখলাম হাতে বই নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। একটু পর লক্ষ করলাম সে না পড়ে আমার আবৃত্তির দিকে মনযোগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রথমে আমি একটু ইতস্তত বোধ করলাম। “জিজ্ঞেস করলামঃ- কি? পড়ছেন না? তিনি বললেনঃ- আপনার আবৃত্তি খুব সুন্দর, শেখাবেন আমাকে? আমি বললামঃ- শেখাব? আপনার বাসায় প্রবলেম হবেনা? তিনি বললেনঃ- না, হবেনা! আমার বাবাও আবৃত্তিটা খুব পছন্দ করেন। আমি বললামঃ- বাহ! তাহলে চলুন কাল থেকেই শুরু করি।” আসলে আমি জানতামই না যে মেয়েটা আমার থেকেও বেশি দারুন আবৃত্তি করে। তারপর থেকে আমিই প্রতিদিন শিখি আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। তার আবৃত্তি যতটা মিষ্টি, দেখতে ঠিক ততটাই মিষ্টি তার চেহারা। এভাবে আমরা প্রতিদিন আবৃত্তি করি। পশ্চিমের সুপারি বাগানে তালপাতার ছাউনির একটা কফি হাউজ আছে আমাদের, কাকা যাওয়ার পরে ওটা আর ব্যবহার হয়নি। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওখানেই কাল থেকে আবৃত্তি করব। এভাবে আমরা আবৃত্তি করতে করতে পেরিয়ে গেছে প্রায় গোটা বছর। আমরা একে অপরকে চিনেছি আরো গভীর ভাবে। কবিতার ছলে আমরা হারিয়ে যাই একে অপরের গহীন রাজ্যে। ৪ নভেম্বর মেয়েটার জন্মদিন, হুট করে আমার মাথায় বুদ্ধি আসে এবারের জন্মদিনটা আমরা কফি হাউজেই উদযাপন করব এবং কাকিমাও আমাকে সাহায্য করে। প্রতিদিনের মত পুরো বিকেল চুটিয়ে গল্প আর কবিতা আবৃত্তি হয়েছে, সন্ধ্যায় ওকে অবাক করে দিয়ে কেইক কাটা। সে সন্ধ্যায় আমি দেখেছি একজন নারীর সৌন্দর্য কতটা আলোকিত, মোমের আলোয় দেখা সেই মৃদু হাসিটা পাগল করে দিতে পারে যেকোন পুরুষকে। এত স্নিগ্ধ, এত আলোকিত মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি জগতে! পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত ঘর তখন আমাদের কফি হাউজ, সে সন্ধ্যায় মজেছি আমি এক নারীর প্রেমে, যার বর্ননা খুজতে গিয়ে আমি বারবার ব্যর্থ হয়েছি! পরবর্তী মাসের শেষ দিকে কাকা বাড়িতে আসছে, কাকা বাড়ি থাকলে আমাদের বাড়িতে মেহমানদের আগমন একটু বেশিই হয়। তাই দুতালার বিল্ডিংটা ফাকা করা ছাড়া আমাদের হাতে কোন অপশন নাই। অনিচ্ছা সত্বেও দুতালার ভাড়াটিয়াদের নোটিশ পাঠাতে হয় বাসা ছেড়ে দেওয়ার। আমাদের শেষ দিন, মানে আবৃত্তিরও শেষ দিন, শেষ বিকেল আর শেষবারের মত আবেগ ভাগাভাগি! আমার খুব কেন জানি খারাপ লাগেনি মেয়েটা চলে যাবে বলে, খুব হাসি মুখেই প্রথম, হয়ত শেষ বারের মত বিদায় বলা। পরেরদিন আমি একা, আবৃত্তিতে ঠিক মনসংযোগ বসাতে পারতেছিনা। কয়েকদিন মেয়েটার অনুপস্থিতি খুব করেই ফিল করলাম। হঠাত একদিন তার ভুল করে ফেলে যাওয়া ডায়েরিটা খুজে পেলাম, তার লেখা কবিতা, লিখে যাওয়া অজানা কথা, পাখিদের গল্প, আমাদের কফি হাউজের গল্প আমাকে মুগ্ধ করে নতুন করে! তার উপহার দেওয়া রুদ্রের কবিতা আমি প্রতিদিন একা একাই আবৃত্তি করি, প্রতিটা শব্দে আমি তার অনুপস্থিতি টের পাই, তার ডায়েরির পাতা নাড়ালে একটা অন্যরকম গন্ধ ছড়ায়, ঠিক নতুন বইয়ের পৃষ্ঠার মত না। আর কানে কানে বলেঃ- “চলো, আমরা কবিতায় হারিয়ে যাই, আমাদের দেখা হবে কবিতার সম্রাজ্যে!”