রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ হয়েছে আমার৷ অথচ, আমি খুশি না হয়ে কান্না করছি৷ বাবা মার হাত-পায়ে পড়ছি৷ আকুতি-মিনতি করছি, ‘আমায় যেতে দাও৷ পড়তে দাও৷ আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো’৷ না, তারা সে সুযোগ দেবেন না আমায়৷ কেনো মতেই আমায় পাঠাবেন না রাজশাহী৷ আমায় ঢাকায়ই থাকতে হবে৷ ঢাকার ভেতর কোথাও পড়তে হবে৷ সে যেকোনো প্রতিষ্ঠান হোক, আমাকে ঢাকাতেই পড়াশুনা করতে হবে।
আমার রেজাল্ট ভালো৷ চান্স হলো ঢাকার নামীদামী এক প্রাইভেটে৷ এবার বড় ভাইয়ার বারণ৷ সাথে বাবারও৷ ওখানে পড়া যাবে না৷ প্রচুর খরচা৷ খুব করে বললাম৷ তাদের মতের দ্বিমত হলো না৷ তাদের সিদ্ধান্ত যা, তাই’ই হবে। ছেড়ে দিলাম হাল৷ চুপসে গেলাম৷ ফুলের মতো৷ ন্যাশনালে ভর্তি হলাম৷
তিনটা টিউশনি করাই প্রতিদিন৷ বিকাল থেকে রাত৷ রান্না করি বাসায় ফিরে৷ ঘর দোর গুছাই সকালে৷ খাইয়ে বিদায় করি বাবাকে৷ বড় ভাইয়ার কাপড় কাচি৷ দুপুরে রান্না করি৷ আম্মু সাহায্য করেন৷ দম ফেলবার সময় নেই৷ দু’ মুঠো খেয়ে দৌড়াই৷ টিউশনিতে৷ আমার জীবন এটাই৷ এই বৃত্তের ভেতরই কাটে দিন৷ কাটে রাত৷ এর বাইরে কিছু নেই৷ বাইরের জগতের সাথে পরিচয় নেই৷ ভার্সিটি যাই না৷ বান্ধু বান্ধব নেই৷ প্রেমিক নেই৷ সময় কোথায় প্রেম করবার?
খুব সুন্দর ছিলাম ছোটবেলায়৷ কোলে নিতো সবাই৷ টিপে দিতো গাল৷ বাবা আমাকে সাথে সাথে রাখতেন৷ কারো কোলে খুব সহজে দিতে চাইতেন না৷ চাইতেন না কেনো, জানি না এখনো৷ পৃথিবীর কতো রহস্যই তো জানে না মানুষ৷ এটা ও একটা রহস্য, বাবা কেন্দ্রিক রহস্য।
দিন দিন কেমন হয়ে গেলাম৷ অবহেলার পাত্রী৷ আমার মূল্যায়ন কমতে থাকলো৷ কমে গেলো আদর, ভালোবাসা৷ বেড়ে গেলো শাসন৷ এইট নাইনে একা হলাম৷ স্নেহ খোয়ালাম পুরোপুরি৷ কোনো কারণ ছাড়াই৷ প্রকৃতির মতো৷ যেমন বড় হই আমরা৷ মরে যাই৷ কাছে ডাকতো না কেউ৷ বলতো না কথা৷ খেতে বলতো না৷ অফিস করতেন বাবা মা৷ বাসায় রেখে যেতেন আমায়৷ একা৷ রুমে আটকে রাখতেন৷ দরজার বাইরে তালা দিতেন৷ আনন্দ, ভয়, একাকিত্বে কেটেছে আমার দিন৷ আমি একাকীত্ব কে সাথী করে নিঃসঙ্গতাকে আগলে বড় থেকে আরো বড় হতে লাগলাম।
বয়সের সাথে সাথে বাড়লো কাজ৷ কাজের লোক হলাম আমি৷ বুয়া৷ বাসায় খাটাতো খুব৷ বলার জায়গা নেই৷ রাজ্যের কাজ করতে হয় আমার৷ সারাদিন ‘খিটখিট’ করে দাদী৷ ফুফুরা করে ‘গ্যাজগ্যাজ’৷ আমায় সহ্য হয় না তাদের৷ আমার সব কাজ ভুল৷ সব কিছুতেই তাদের ‘বা হাত’৷ ‘এটা এমন কেনো? ওটা ওমন কেনো?’ দুনিয়া জুড়া নালিশ তাদের৷ বাবার কাছে৷ মার কাছে৷ শান্তি নেই বেড়াতে গেলেও৷ কাজ আর কাজ৷ দুনিয়ার সব কাজ করতে হবে আমায়৷ আমি ছাড়া যেনো কেউ নেই৷ সবচে বেশি করাতেন ফুফুরা৷ মানসিক এক অসহ্য যন্ত্রণাকে সয়ে আমি বয়ে বেড়াতাম।
আমার সাড়া গায়ে এলার্জি৷ অনেক আগে থেকেই৷ এখন ভয়াবহ৷ অষুধ খেতে হয় সারা মাস৷ সমস্যা আরেকটা হয়েছে এখন৷ হাত পা ব্যাথা করে৷ সোজা করতে পারি না কোমর৷ ব্যাথায় মরে যাই৷ হাঁটতে পারি না৷ ডাক্তার বলেছে, প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল৷ চিকিৎসা হচ্ছে না আমার৷ টাকা পয়সার খুব টান৷ টিউশনি করাতে পারি না৷ ভার্সিটি আর হাত খরচটা পাওয়া যেতো৷ তাও নেই৷ বাবার কাছে চাইতেও ইচ্ছে করে না৷ চেয়েই বা কি লাভ?
ডাক্তারের আশঙ্কাই সত্য ফলেছে৷ প্যারালাইসিস হয়েছে আমার৷ অবস হচ্ছে হাত পা৷ অষুধ পাচ্ছি না আমি৷ সেবা পাচ্ছি না৷ পাচ্ছি না স্নেহের হাত৷ অবহেলা, অনাদরে কাটছে আমার দিন৷
বাসায় পড়ে থাকি দিন রাত৷ মাথায় উকিঝুকি দেয় ছেলেবেলা৷ শৈশব৷ আমি খোঁজে ফিরি সেই সব দিন৷ সেই সুন্দর আমি৷ সবাই কোলে নিচ্ছে৷ টিপে দিচ্ছে গাল৷ আহা! ভাবনা আরেকটু এগুলেই খারাপ লাগে৷ বিষাদে ভরে যায় মন৷ একটা বাচ্চা মেয়েকে ঘরে আটকে রাখা৷ এতো এতো কাজ৷ সবার বকাঝকা৷ বাবা মার অবহেলা৷ উফ! ভাবতে পারি না৷
একাকীত্ব গ্রাস করে আমায়৷ বোর হয়ে যাই৷ হাজার রকম চিন্তা আসে মাথায়৷ এই জীবন কি দিয়েছে আমায়? এই ফ্যামিলি? আত্মীয় স্বজন? অবহেলা, অনাদরে বেঁচে থেকে কি লাভ? স্বপ্নহীন ঘুরে? যে জীবনে স্বপ্ন নেই, নেই ভালোবাসা, সেটা জীবন? ইচ্ছা করে, চলে যাই সব ছেড়ে৷ দূরে৷ বহুদুরে৷ একা৷
রাজশাহী আমার বাবার বাড়ী৷ মা-বাবা ঢাকা এসেছেন৷ ঘুরতে৷ খুব ছোট আমি৷ বাবা মারা যান রোড এক্সিডেন্টে৷ মাও৷ সেই যে একা হলাম, এখনো একাই৷ এতো এতো মানুষের ভেতরও আমি একা৷ বাবা, মা, ভাই, ফুফু, দাদী কেউ আপন না৷ আমি কারো আপন না৷ কুড়িয়ে পাওয়া মানুষ কারো আপন হয় না৷