Friday, May 23, 2025
29 C
Dhaka

নেই কোনো ভাবনা

আদিত্য আবরার

১.
রয়্যাল ফ্যামিলির আদুরে বাচ্চার মতো বাগানের প্রতিটা গাছ বেড়ে উঠেছিল। বড় হয়েছিলো কোনো আঁচড় কিংবা নখ দাঁতের আকর ছাড়ায়। পরিবেশের যে কোনো ক্রেডিট একেবারেই নেই ব্যাপারটা এমন নয়। বাঁশ বাগানের যে শত্রুতা সূর্যের সাথে রয়েছে সেটা পাশে থাকা মেহগনি গাছগুলো বেশ ভালোভাবে টের পায়। রাত তো প্রকৃতিই অন্ধকার করে, কিন্তু বাঁশ বাগান তাদের দিনকেও রাতে পরিণত করে। ওদের বেড়ে ওঠাতে সময়ের অশুভ কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছিল মকবুল চাচার বিরাটকায় বাঁশের ঝাড়। খুব আয়েশ করে পাঁন চিবুতে চিবুতে নিজের বাঁশ বাগানের পরিচর্যা নিতেন তিনি। মাস পর পানি আর সার-মাটি দেয়াতে কক্ষনো কমতি হয়নি তার। আর কমতি হবেই বা কিভাবে। বাড়ীতে অসুস্থ বউ, তাকে সেবা করার জন্যই একজন লোক সর্বদা বাড়ীতে থাকে! মকবুলকে আর কে শান্তি করে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াবে! অবশ্য এটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। বড় ছেলেকে অনেক কষ্ট করে বিদেশ পাঠিয়ে আরো মাস্তিতে আছে মকবুল। ঝাড়ের নীচে একটা বাঁশের মাচান বানিয়ে সারাদিন শুয়ে থাকা আর একটু খড়ির অভাবে পাতা খুঁটতে আসা মেয়ে কিংবা মহিলাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উল্টাপাল্টা টাইপ কথা বের করা তার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অবশ্য শুক্রবারের নামাজ মসজিদে যখন পড়তে যান তখন তার গর্বের একটা বিষয়ই থাকে এই বাঁশবাগান। “বাঁশ লাগবি, তাই তো! মজজিতের বারান্দাত একখান বাঁশ রশি দিয়া টানায়া দিলিই তো রেহাল রাখার তাক হয়া যায়” এসব বলে বলে প্রতি শুক্রবারে মসজিদের নয়া মুয়াজ্জিনকে কনফিউজড করাও একরকম অভ্যাস হয়ে গেছে। যেখানেই যাক ফিরে এসে আবার বাঁশবাগানে। মকবুলের তাকানো দেখে মাঝে মাঝে যে কোনো ভূতও হয়ত চমকে উঠবে। এইতো সেদিন এক মুচির ছেলে এসেছে খড়ি কুড়াতে, মকবুলের ‘কেরামবোর্ডের গোল গোল গুটির মতো বড়ো বড়ো চোখ দেখে ছেলেটা ভয়ে একেবারে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল। অথচ মকবুল তাকিয়ে ছিল ঐ মেহগনি বাগানের দিকে। একরকম ট্যারা বললেও ভুল হবে না হয়ত! কত্ত সুন্দর ওদের বেড়ে ওঠা। কোনো আগাছার বালাই মাত্র নেই ওখানে। গাছগুলোর লম্বা হওয়া দেখছে সেই ছোট হওয়া থেকে। কোনো অযত্ন নেই। যেন এখানে কোনো অযাচিতের জন্ম নেয়া মহাপাপ। ওদের উৎপত্তি এখানে অস্থিরত্ব। রাহেলাই ওদের গুরুজন। দেখাশোনার একমাত্র মালিনী রাহেলা।
২.
বিয়ের প্রথম এনিভার্সারি। একটু উত্তেজনা থাকা স্বাভাবিক। অফিস থেকে ফেরার পথে বিশাল কেক ছুরি আর কয়েকটা মোমবাতি নিয়ে বাড়ীর প্রধান যে হাজির হবেন, এটা অনেকেই কল্পনা করেন। ভেবে আনন্দিত বোধ করেন ভেতরে ভেতরেই। অনেকে অবশ্য এটাকে তার কাজ কর্মের ভেতর দিয়ে প্রকাশও করে ফেলেন খুব নিশ্চিন্তে। যেমন “আপু তুই কেমন আছিস রে! কতদিন দেখিনা তোকে। আজ সত্যিই দেখতে মন চাচ্ছে। কিন্তু কী করব বল, এখান থেকে তো যাওয়া সম্ভব নয়”! রিমি এমনভাবে কথা গুলো বলল যেন আজ অনেকদিন পরে ওদের দ্বিতীয় দফার কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কিন্তু বিষয়টা এমন না। প্রতিদিন নিয়ম করে ওদের দু’বোনের পঞ্চাশ থেকে ষাট মিনিট কথা হয়। তারপরেও কেন আজ এত্ত খুশি, ব্যাপারটা আনমনেই জিজ্ঞাসা করেছিলো রাহেলা। পরে অবশ্য জেনেছিলো যে তার অস্ট্রেলিয়া থাকা ছোট বোনটার আজ দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী। সব ঠিক আছে, কিন্তু নিয়ম করে পঞ্চাশ থেকে ষাট মিনিট কেন কথা বলে রিমি!
তুষার পড়া রাস্তাতে হাঁটতে যেমন একটা আনন্দঘন বিষয় থাকে, তেমনি থাকে একটা সুক্ষ্ম ভয়ের বিষয়ও। পাসপোর্ট, কিছু টাকা আর একটা মেয়েলি বিষয় থেকেই যায়, জনমানবহীন একটা সরু গলি দিয়ে প্রতিদিন রিমি বাসায় ফেরে। এটা নিয়ে রাহেলা প্রথম প্রথম অনেক কথায় বলেছিল যে, তোর কেন চাকরি করতে হবে! হাবিব তো চাকরি করছেই। আরো অনেক অনেক জিজ্ঞাসা করেছিলো রাহেলা। কিন্তু রিমির এক উত্তরে একেবারের জন্য এ প্রশ্ন থেকে নিশ্চুপ হয়ে গেছে রাহেলা। হাবিব বাংলাদেশি হলেও কৃষ্টি কালচারে এ দেশের অনেক মনোভাবই তার ভেতরে অণুপ্রবেশ করেছে। যখন তখন রিমির দু’বছরের বাচ্চা আর রিমিকে ফেলে চলে যাওয়াটা একদম স্বাভাবিক একটা ব্যাপার বলে ধারনা করে নেয় অন্যান্যদের মতো রিমিও। এজন্যই এমন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে হলেও চাকরিটা যে তাকে করতেই হচ্ছে এটা সুস্পষ্টত। টাইম ফিক্সড করে কথা বলার কারণটা এতক্ষণে হয়ত আরো খোলাসা হয়েছে।
ব্লিচিং পাউডারে অনেক্ষণ হাত ভিজিয়ে রাখতে রাখতে হাতের কোণাগুলো কেমন যেন একটু বেশি নরম হয়ে গেছে। তারপরেও অনেক দ্রুত কাজগুলো সেরে নিচ্ছে রাহেলা। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আর বাড়তি টেনশন যারা করে তাদের ঘুম আর আয়েশ দু’টোই উবে যায়। একটু উষ্কখুষ্ক আর বেমানান সব ত্বক নিয়ে কখনো তারা বসে থাকে না। নিজের অস্বিত্ব জানান দিতে যেমন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি বর্ষন করে, তেমনি নিজের উদ্যমতা প্রকাশ করতে মানুষও করে পরিশ্রম। রাহেলা’র আজ প্রথম বিবাহ বার্ষিকী হলেও প্রতিটা পদক্ষেপ আজ উল্টো বলে বিবেচিত হচ্ছে। বাড়ীতে কাজের বুয়াকে ছাড়ায় সব কাজ নিজে নিজে গুছিয়ে নেয়া আর অতিরিক্ত ক্লান্তিতে কাজের গতি শ্লথ হয়ে আসা থেকেও নিজেকে বেশ সহজভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
এগুলোর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কি না সেটা নিয়ে তো কেউ জিজ্ঞাসা করেনি!
৩.
একটু ঢিলেঢালা শেলোয়ার কামিজেও শরীরের গড়ন খুব ভালোভাবে আঁচ করে মকবুল। উঁচু হয়ে থাকা বক্ষদেশ আর মাজা ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা চুল দেখে অনেক কিছুই মনে মনে ভাবে। যখন নামাজে রুকু দেওয়ার মতো ঝুকে গাছগুলোর পরিচর্যা করতে উদ্বুদ্ধ হয় ও বাড়ীর মেয়েটি, মকবুল খুব অস্থির হয়ে বেঁকে বসে মর্দনহীন ফর্সা হয়ে নেমে পড়া স্তন দুটোকে দেখতে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজেকে সামাল দিতেও বেশ কষ্ট করতে হয় মকবুল কে। দাঁড়িয়ে যায় কোনো গোপন অঙ্গ, স্থির রাখতে পারে না নিজ হস্তকে। এগুলো কেন হচ্ছে নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেনি মকবুল। বাড়ীতে থাকা বউকে তার উটকো ঝামেল মনে হয় এখন। তার একটু ভালো কথাতেই মেজাজ চড়ে যায় মকবুলের। শান্তিতে থাকার উপায় তো আরো আগেই ঘর থেকে বিদায় দেয়া হয়েছে।

বিয়ের প্রথমদিন সব মেয়েই একটা ভয়ে ভয়ে থাকে। অবশ্য মনে মনে আনন্দ অনুভব যে একেবারেই করে না, ব্যাপারটা এমন না। কাগজ কলম কিংবা মুখে দুই তিনটা শব্দ উচ্চারণের পরেই যে একটা বন্ধন সৃষ্টি হয়, এটা বিবাহ। অল্পতে আনন্দটুকু উবে যায়, মনে হয় স্থায়ী কোনো ঠিকানায় ঠেলে দিচ্ছে কেউ। এজন্যই ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের কোলে বাবার বুকে আবার কখনো সারাদিন মারামারি করা ছোট ভাইটির গলাতে! ভালোবাসা কিংবা মমতার স্থায়িত্বের বহিঃপ্রকাশ তখন এমনিতেই ঘটে যায়। রাহেলা এগুলা কিছুই করে নি। চুপচাপ কারো বাসায় গিয়েছিল। মাত্র তিনটা আরবি শব্দের নাম কিংবা কিছু টাকার বিনিময়ে। এতে কেউ কেউ অবাক হয়নি এই ভেবে যে বাড়ীর বড় তো, একটু শক্ত এই আর কি। আবার কেউ কেউ রীতি রেওয়াজের মাথা খেয়ে ফেলার কথাও বলেছিল! রাহেলা শুনেছিল কিছু কিছু বাক্য। কিন্তু চুপচাপ।
পরদিন যখন ভ্যানিটিব্যাগ কাঁধে করে বাড়ীতে ফিরে আসে রাহেলা তখন কারণ শুনতে গ্রামের সবাই ভীড় জমিয়েছিল। কিন্তু গেট একেবারেই না খোলাতে আবার কিছু কথার জন্ম নিয়েছিল। যেগুলো শ্রুতিকটু। ভালো না লাগার মতো কিছু কথা।
৪.
একটা ভুল হয়ে গেছে আমার! ক্ষমা কি পাব?
অপরিচিত কারো কাছ থেকে এমন কথা শুনলে যে কেউ ভ্রান্তিতে পড়বে। ভ্রান্ত না, শুধু অবাক হয়ে শুধু জ্বি বলেছিল রাহেলা।
প্রশ্নের সুর শুনে যে কেউ বলবে লোকটি ফান করছে! মিটিমিটি হেসে যে কোনো তরুণী বলতেও পারত যে, আরে আপনি আবার কী ভুল করলেন? আপনাকে তো কখনো দেখিই নি! পরক্ষণে “প্লিজ” শুনে হয়ত বলত, আচ্ছা বলেন।
রাহেলা এখনো প্রশ্নের সুর ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবছে। ভাবছে লোকটা কেমন। হাতে একটা টিকেটের কপি আর কাগজ দিয়ে কখন যে চলে গেছে, অতিরিক্ত মোহে টেরই হয়ত পায় নি।
চিটাগাং এর টিকেট, কখনো আর এ বাড়ীতে ফিরবে না সেই কথা সাথে বাবা মায়ের কথা রাখতে এ বিয়ে করা আর পাসপোর্ট সাইজে একটা ফুটফুটে মেয়ের ছবির উপরে “এটা আমার মেয়ে লেখা”।
৫.
মকবুলের আগ্রহ এখনো কমেনা। মেহগনি বাগানের পরিচর্যা করতে আসা মেয়েটির দিকে তাকাতেই মনে হয় পূর্ব যৌবন ফিরে পায়। এ মানুষগুলো কখনো মানব হবে না। এমন মকবুলদের পৃথিবী অনেক সময় দেয়। বেঁচে থাকে এরা। লোলুপতা তাদেরকে করে আবিষ্ট।

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

সিরাজদিখানে অপারেশন ডেভিল হান্টে আওয়ামীলীগ নেতা ফেরদৌস গ্রেফতার

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করে ফেরদৌস (৫৫)...

আইএসপিএবি ২০২৫ নির্বাচনে আমিনুল হাকিমের নেতৃত্বে ‘আইএসপি ইউনাইটেড’ প্যানেল

আসন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) ২০২৫–২০২৭...

বাংলাদেশ থেকে ১.৫ মিলিয়ন টন আম নিতে আগ্রহী চীন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার কেন্দুয়া ঘাসুড়া এলাকার একটি রপ্তানিযোগ্য আমবাগান...

‘স্টারলিংক‘-এর লাইসেন্স অনুমোদন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্রের এনজিএসও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘স্টারলিংক‘-এর লাইসেন্স অনুমোদন করেছেন প্রধান...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img