ফিদা আল মুগনি
বিদ্রোহী কবির কথা বললেই যে ছবিটা প্রথমেই মনে আসে সেটা হলো বাবরি চুলের ভাবুক চোখের একজন ব্যাক্তি।ছোট থাকতে যেমন পেয়ারা গাছের দিকে তাকিয়ে “খুকি ও কাঠবিড়ালি” পড়ে আমরা হেসেছি,আবার আমরাই ইকটু বড় হয়ে “সাম্যবাদী” পড়ে চোখমুখ লাল করে ফেলেছি।সেই বর্ধমানের চুরুলিয়ার দুখু মিয়া থেকে নজরুল হয়ে ওঠার গল্পটাও সবাই জানি কমবেশি ।
এবার নজরুলের ১১৮ তম জন্মবার্ষিকী। প্রতিবারের মত এবারও ধুমধাম করে সবাই পালন করবে দিনটা নজরুলগীতি গাইবে কেউ,কেউ কবিতা পড়বে। প্রতিবারের মতন এবারও দিনটা কবির জন্যই উৎসর্গ থাকবে। ভাবতে অবাকই লাগে,জীবদ্দশায় তিনি খুব কম ভালোবাসা পেয়েছিলেন তো বটেই, এমনকি তার অসুস্থ থাকাকালীন সময়েও সাহায্য কমই পেয়েছিলেন।
বেশিরভাগ বিখ্যাত মানুষদের মত কবিরও পড়ালেখার দিকে মন ছিলনা। ভালবাসতেন গান করতে, বাঁশি বাজাতে, এলাকার সবাইকে বিরক্ত করতে। নিজ চাচা বজলে করিমের লেটো দলের সাথে থেকেই উর্দু আর ফারসি ভাষার ব্যাবহারটা ঝালাই করে নেন তিনি । তারপর চায়ের দোকানে অথবা মসজিদে,কবিতা কিংবা গজল শুনিয়ে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে । তারপর একদিন শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ । নজরুল এবার হাতে কলম ছাড়াও তুলে নেন অস্ত্র । অবশ্য সহকর্মীদের কবিতা আর গান শুনিয়ে বরাবরই মুগ্ধ করে রাখতে পারতেন তিনি ।১৯১৭ থেকে১৯২০ পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর যুদ্ধ শেষ হলে কলকাতায় ফিরে আসেন । কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির আপিসে থাকতে শুরু করেন,এখানেই শুরু হয় তার সাহিত্যিক হিসেবে আত্বপ্রকাশ । এখান থেকেই মোসলেম ভারত,বঙ্গীয় আর নান পত্রিকায় লেখা শুরু করে বিশিষ্টদের নজরে আসেন।
নজরুলেই বেশিরভাগ রচনায় দেখা যায় সাম্যের কথা, জীবনের কথা অথবা বিদ্রোহের কথা ।অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আত্বপ্রকাশ করেন । মজার ব্যাপার হলো এখানেও তার কাজ ছিল সভায় যাওয়া আর শোভাযাত্রায় গান গাওয়া । ব্যাপারটা খুবই অন্যরকম লাগে যখন মনে মনে চিন্তা করি কবি নজরুল সবার সামনে বসে “ভিক্ষা দাও ভিক্ষা দাও” গান গেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন । তারপর আসে তার সেই ১৯২২ সাল । বিদ্রোহী কবিতা,সেই “বিদ্রোহী” লিখার পর এবার সরকারের চোখেও পড়ে যান তিনি ।একই বছর নভেম্বরে যুগবাণী পত্রিকা বাযেয়াপ্ত করে তাকে শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয় ।
ব্যাক্তিগত জীবনে লাজুক ব্যাক্তিটি আদতে খুবই আত্বসম্মানবোধের অধিকারী । ঘরজামাই করার কথা শুনে তাই প্রথম স্ত্রী নার্গিসকে ফেলেই চলে আসেন প্রমীলা দেবীর কাছে।
১৯৪২ সাল । কবি নজরুল নবযুগের পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করেন,এমন সময় আক্রান্ত হন সেই দুরারোগ্য পিক্স ডিজিজে । এত বড় মাপের একজন কবি হয়েও রোগের সময় পর্যাপ্ত চিকিৎসাতো পাননিই বরং চিকিতসার সময়ও ব্রিটীশ চিকিতসকেরা তার কাছে অনেক অর্থ দাবী করেন যা নিজের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না একদমই । ১৯৭১ সালে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয় এবং দেশে নিয়ে আসা হয় । ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
ছোট্ট কবিজীবনে তিনি মানুষকে শিখিয়ে গেছেন অনেক কিছুই । সাধারনের চিন্তাভাবনার ওপরে ছিলেন সবসময়ই কিন্তু সবার কথাই ভেবেছেন । ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় ,কি করে করতেন তিনি এতকিছু,কি করে পারতেন ?