ইভান পালঃ
বিগ ব্যাং তত্ত্ব। সে আবার কি? কেউ কেউ বা ভাব্বে বড় কোন ব্যাং নাকি অন্য কিছু।
না প্রিয় পাঠকগণ।
বিগ ব্যাং কোন বড় ব্যাং এর কথা বলছি না।
কথা বলছি, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে আজকের যে আধুনিক বিজ্ঞান তার প্রদত্ত তথ্য নিয়ে।
এই তথ্যে উল্লেখিত আছে, বর্তমান মহাবিশ্বের সকল বস্তু এক সময় একটি বীজ আকারে একত্রিত অবস্থায় ছিল। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি বছর আগে এই মহাবিশ্বে এক মহাবিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফারণ এর প্রথম তিন মিনিটে বিশ্বসৃষ্টির বিভিন্ন উপাদান গঠিত হয় এবং তা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই তত্ত্ব অনুসারে এভাবেই সৃষ্টি হয় এই মহাবিশ্ব।
তবে এই তত্ত্বটির স্বপক্ষে রয়েছে তিনটি প্রমাণ।
প্রথম প্রমাণে বলা হয়েছে,
“এই মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি সমূহ পরস্পর পরস্পরের নিকট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি,একসময় এসবকিছু একতত্রিত অবস্থায় ছিল।”
দ্বিতীয় প্রমাণে বলা হয়েছে,
বিগ ব্যাং এর সময় মহাবিশ্বের উষ্ণতা ছিল অনেক। পরবর্তীতে তা আস্তে আস্তে কমে।
আর সবশেষে —
বর্তমান মহাবিশ্বে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের পরিমান। এই দুয়ের পরিমাণ বিগ ব্যাং তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
( বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত ছোটদের বিজ্ঞানকোষ থেকে)
এই বিগ ব্যাং নিয়ে সব থেকে আধুনিক তথ্য দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন বিশ্বের বিষ্ময় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।।।
জন্মেছিলেন ৮জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। তিন শত বছর আগে ঠিক এই দিন টায় আবার বিদায় নেন বিজ্ঞানের আরেকজন শ্রদ্ধাভাজন পন্ডিত মহাবিজ্ঞানী গ্যালিলিও।
যাক, সেদিকে যাচ্ছি না।
স্টিফেন হকিং জন্মেছিলেন ইংল্যান্ড এর অক্সফোর্ড এ। তারঁ বাবা ছিলেন একজন চিকিৎসক। সাথে জীববিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা ধর্মী কাজও করতেন। তারঁ মা ও চিকিৎসা গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
পড়াশোনায় হাতে খড়ি হয় আলবানস স্কুলে। এটি ছিল একটি মেয়েদের স্কুল। সে সময় ছেলেরা ১০বছর পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারতো। যাক, এরপর তিনি স্কুল বদলিয়ে চলে যান ছেলেদের স্কুলে।
পিতা উইলিয়াম হকিং এর ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হবেন। কিন্তু স্টিফেন এর ইচ্ছে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়বেন। তাও আবার গাণিতিক বিষয়াবলি নিয়ে। ছেলের এই উদম্য উৎসাহ দেখে বাবা উইলিয়াম আর বাধঁ সাধলেন না। স্টিফেন ভর্তি হলেন অক্সফোর্ড এ।
খুব সফলতার সাথে শেষ করলেন অক্সফোর্ড অধ্যায়। কেন, সফল হবেন না। যেখানে এত্ত ভালবাসা, এত্ত আগ্রহ সেখানে তো জয় হবেই।
এবার তারঁ ইচ্ছে তিনি পা বাড়াবেন ক্যাম্ব্রিজ এর দিকে। কারণ সেখান আরো পড়াশোনা করে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার ইচ্ছে তারঁ।সাথে চালাবেন গবেষণা ও।
১৯৬২ সালে তিনি যোগদেন বহুল প্রত্যাশিত ক্যাম্ব্রিজের গবেষণায়। সেখানে শিক্ষকতায় নিযুক্ত আছেন বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী ও গবেষক ফ্রেড হয়েল।
যাক, একদিন কোন এক গবেষণা মূলক কাজের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীরা একত্রিত হল।
মহাকাশ বিজ্ঞানী ফ্রেড বিভিন্ন তথ্যের উপরে ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিলেন। দিয়ে গিয়ে বসলেন।
তখন সেই বিজ্ঞানীদের ভেতর থেকেই তরুণ এক ছেলে উঠে জবাব দিল, ফ্রেড এর তথ্য ভুল ছিল। তার একথা শুনে উপস্থিত সকলের মাথায় যেন বাজ পড়ল। বলা চলে, ফ্রেড একরকম পন্ডিত ই। তাকেঁ নিয়ে এমন মন্তব্য!
ফ্রেড নিজেই হতভম্ব।
পরে ফ্রেড সহ সকলের সামনে এই তরুণ তৎক্ষনাৎ অংক কষে ভুলের সমাধান করেন। এই ঘটনা দেখে ইত:স্ততায় পড়ে যান ফ্রেড ও।
তবে স্বীকার করেন যে — এই ছেলে খুবই মেধাবী।
শিক্ষকের ভুল ধরিয়ে দেওয়া এই ছেলেটির নামই হল স্টিফেন হকিং।
খুব ভাল ভাবেই চলছিল তারঁ দিন কাল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারঁ শারীরিক বিপর্যয় আস্তে থাকে। কথা বলতে সমস্যা, হাত পা কাপাঁ এরকম কিছু উপসর্গ। কিন্তু তিনি এসব পাত্তাই দিতেন না। পরে অবস্থা বেশীই বেগতিক হলে হাস্পাতালে ভর্তি হন। আর জানতে পারেন, এক প্রকার স্নায়ুঘটিত রোগে ভুগছেন তিনি। যেটাকে মোটর নিউরন রোগ ও বলা হয়ে থাকে।
যাক, জীবন কখনো থেমে থাকে এর প্রমাণ যেন তিনি ই নিজে। মস্তিষ্কের এই রোগ নিয়েই চলতে থাকে তারঁ বিজ্ঞান ভিত্তিক কর্মকান্ড।
জীবনের ২৫ বছর বয়সে শেষ করেন মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা ধর্মী কাজ।লাভ করেন ডক্ট্রেট ডিগ্রী। বিয়ের পিড়ীতে বসেন বান্ধবী জেনের সাথে।
সাল টা যখন ১৯৬৭ তখন মহাকাশে ধরা পড়ে পালসারের অস্তিত্ব।আর তার থেকে আসে Black hole এর ধারণা। আর এই Black hole নিয়েই কিন্তু কাজ করছিলেন হকিং।
১৯৭০ সালে প্রমাণ করতে সক্ষম হন Black holes তেজস্ক্রিয়াতা বিকিরণ করতে পারে। এদিকে প্রতিদিন ই তারঁ শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রথমে লাঠি আর পরে ক্র্যাচ নিলেন হাটাঁ চলা করতে।
১৯৮৫ তে আক্রান্ত হন নিউমোনিয়ায়। তখন তিনি সুইজারল্যান্ড সফর করছিলেন।শ্বাস নালিতে বিশাল সমস্যা দেখা দেয়। অস্ত্রপচার করা হয়। বসানো হয় কৃত্রিম শ্বাস নালী।
কিন্তু বাক শক্তি হারান এই অস্ত্রোপচার এ। শরীরে দুটো আঙ্গুল ছাড়া আর মাথাটা কোনভাবে ঘোরাতে পারতেন। এটুকুই। এই রোগ তাকেঁ বলা চলে এক প্রকার প্যারালাইসিস ই করে দিয়েছিল।
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্টিফেন এর এ অবস্থার কথা জানতে পেরে একটি বিশেষ ধরনের প্রোগ্রাম তৈরি করে স্টিফেন এর কাছে পাঠান। আর এই প্রোগ্রাম দিয়ে তিনি খুব সহজেই মাত্র দুটি আঙ্গুল ব্যবহার করে সুইচ চেপে কিছু বর্ণ বেছে নিয়ে শব্দ গঠন করতে পারতেন। কম্পিউটার এর সাথে সংযুক্ত একটি যন্ত্র থাকে এতে যাতে সুইচ চাপলেই গঠনকৃত শব্দগুলো একটি কৃত্রিম কন্ঠস্বর
পড়ে শোনাতেন। এই যন্ত্রটির নাম “Speech Synthesizer”।
“A Brief History of Time: From the Big Bang To Black Holes” তারঁ বিখ্যাত একটি বই। ১৯৮৮ সালে তারঁ এই বইটি প্রকাশিত হয়।
বইটির এতোই চাহিদা ছিল যে বইটি আরো ৩০টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
পৃথিবী ৯মিলিয়নের ও বেশী এই বইয়ের কপি বিক্রি হয়। আর বইটির এত্ত চাহিদা আর দুর্দান্ত সব তথ্যর কারণে তিনি পরিচিত হন আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা একজন পদার্থ বিজ্ঞানী হিসেবে।
মহাবিশ্ব কি,এর সৃষ্টি রহস্য, কবে থেকে এই মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু হল, Black Holes কি? ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এই বইটি লেখা হয়েছিল।
তারঁ এই সুত্র ধরেই কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা মহাকাশ নিয়ে “Big Bang” পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীত ফেলো এবং পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন।
২০১৪ সালে এই মহান পন্ডিত বিজ্ঞানী কে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়। যেটির নাম
“থিওরি অব এভরিথিং”।
নিজের বই বা বক্তৃতায় নানা প্রসঙ্গে হকিং “ঈশ্বর” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে
তারঁ স্ত্রীসহ অনেকে তাকেঁ একজন
নাস্তিক হিসাবে বর্ণনা করছেন।কিন্তু, হকিং নিজে ও মনে করেন তিনি “সাধারণ অর্থে ধার্মিক নন” এবং তিনি বিশ্বাস করেন “পৃথিবী বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই চলে। এমন হতে পারে নিয়মগুলো ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন কিন্তু তিনি নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটানোর জন্য কখনো হস্তক্ষেপ করেন না”। (উইকিপিডিয়া)
২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজি কেন্দ্রে হকিংয়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা। ২০০৮ সালের মে মাসে হকিংয়ের আর একটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে অবস্থিত আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের সামনে। মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদর তাদের রাজধানী সান সালভাদরে বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম হকিংয়ের নামে রেখেছে। (উইকিপিডিয়া)
এই মহান বিজ্ঞানী তারঁ এই জীবনে অর্জন করেছিলেন বহু পুরষ্কার,বহু আওয়ার্ড।
অবদানের জন্য নিম্নোক্ত পদক ও পুরস্কার অর্জন করেছেন।
অ্যাডামস পুরস্কার, এডিংটন পদক, ম্যাক্সওয়েল পদক সহ
ডিরাক পুরস্কার বিখ্যাত।
যাক, মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করা এই শ্রেষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি বহু আগেই মারা যেতেন তারঁ অসুখের কাছে।শুধুমাত্র নিজের মনোবল কে সাথে নিয়ে লড়াই করে গেছেন জীবনের দীর্ঘ সময়। অবশেষে হার মানলেন সেই মৃত্যুর কাছেই। আজ ১৪ই মার্চ বুধবার ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন আধুনিক বিজ্ঞানের শ্রেষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, পন্ডিত স্টিফেন হকিং।।
শ্রেষ্ট এই পদার্থবিজ্ঞানীর মৃত্যু তে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জানাচ্ছি চ্যানেল আগামী পরিবারের পক্ষ থেকে।
The End