Monday, April 28, 2025
27 C
Dhaka

সেনা অভ্যুত্থানের হুমকিতে ইরান

চলতি বছরের শুরু থেকেই ইরানে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ দেখা গেছে। জানুয়ারিতে দেশটির ২৯টি প্রদেশের ৮০টিরও বেশি শহরে সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে; এতে অন্তত ২১ জন মারা যায়।

তেহরানে স্কার্ফ পরা বাধ্যতামূলক হলেও ফেব্রুয়ারির শুরুতে এর বিরোধীতায় বিক্ষোভ করে দেশটির নারীরা। এই বিক্ষোভ থেকেও কয়েক ডজন নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই মাসের শেষের দিকে, পুলিশ গোনাবাদি সুফি মতাদর্শীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে।

মার্চের শেষের দিকে, ইরানের জাতিগত বৈচিত্রতা নিয়ে দেশটির একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানে আরবীয় বংশোদ্ভূতদের বাদ দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে জাতিগত সংখ্যালঘু আরবরা খুজেসতান প্রদেশে বিক্ষোভ করেন।

আসারামের

চলতি মাসে (এপ্রিল) ইসফাহান প্রদেশে তীব্র পানি সংকটের জেরে বিক্ষোভকারীদের ওপর ব্যাপক চড়াও হয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন শহরে ধারাবাহিকভাবে শ্রমিক ধর্মঘটও চলছে। এসব বিক্ষোভ ছাড়াও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, তীব্র খরা এবং সিরিয়ায় সামরিক সম্পৃক্ততাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।

একই সময়ে এসব সমস্যার কোনোটিরও সমাধান করতে পারেনি দেশটির সরকার। এসব উত্তেজনার মাঝে দেশটির বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের মেয়াদ শেষ হবে ২০২১ সালে। এদিকে, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নির্দেশ দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনী পালন নাও করতে পারেন; এমন বেশ কিছু অালামত স্পষ্ট হয়েছে।

রাজনৈতিক পুঁজি হারাচ্ছে সরকার

তবে ইরানের রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি একটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, এসব সংকটের সমাধান হতে পারে শুধুমাত্র মৌলবাদী নিয়ম-নীতির সংস্কারের মাধ্যমে। কিন্তু সংস্কার হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। কেননা এতে ইরানের দ্বৈত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রধান বাধা হতে পারে।

দেশটির প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টসহ নির্বাচিত অন্যান্য সংস্থাগুলো ফলপ্রসূ কোনো পরিবর্তন আনতে অক্ষম। কারণ তাদের ক্ষমতা কাঠামোগতভাবে সীমিত। একই সময়ে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীসহ অন্যান্য অনির্বাচিত সংস্থাগুলোর ব্যাপক রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে। এই অনির্বাচিত সংস্থাগুলো মনে করে, সরকারের অদক্ষতার কারণেই বর্তমানে সংকট তৈরি হয়েছে।

প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর ইরান

বিদ্যমান ব্যবস্থায় সংস্কার আনা হলে তা দেশটির সর্বোচ্চ নেতার ভিতকে দুর্বল করতে পারে। ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার মেয়াদে যতজন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন; মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে তাদের অনেকের সঙ্গে তার তিক্ত সম্পর্ক দেখা গেছে।

একচেটিয়া ক্ষমতা এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে গভীর বাসনাও দেখিয়েছেন তিনি। ইরানি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে একটি সাধারণ একটি বিশ্বাস রয়েছে যে, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন দেশটিতে সংস্কার কিংবা পরিবর্তন অসম্ভব। এছাড়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও সর্বোচ্চ নেতার মধ্যে ব্যাপক মত-পার্থক্য দেখা গেছে।

২০১৩ সালে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হিসেবে রুহানি পেয়েছিলেন। কারণ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানো এবং নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য মধ্যপন্থী রাজনৈতিক নেতার দরকার ছিল।

কিন্তু দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে তা ইরানের ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য ক্ষতিকর হবে। তেহরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে ওয়াশিংটন। এর ফলে সরকার দেশের ভেতরে যে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে সে ঝুঁকিও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এছাড়া যারা দেশটিতে ফলপ্রসূ পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছেন, তাদের কাছে রুহানি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। তার নতুন উদার অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে ইতোমধ্যে ইরানের দরিদ্র এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তবে পরিস্থিতি যদি আরো খারাপ হয় এবং নিজের শাসন ক্ষমতায় থাকা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়, তাহলে যেকোনো মুহূর্তে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি প্রেসিডেন্ট রুহানিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পারেন।

ইরানের কট্টরপন্থীরা বিশ্বাস করেন, ইরানের সমস্যা এবং পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া ক্ষমতার বিরুদ্ধে একমাত্র আত্ম-নির্ভরতা এবং প্রতিরোধই আনতে পারে সমাধান। আয়াতুল্লাহ খামেনি এই মুহূর্তে সর্বোত্তম যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা হলো ক্ষমতা থেকে মধ্যপন্থীদের উৎখাত এবং কট্টরপন্থীদের পুনর্বাসন।

ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে পরিবর্তন এবং সামরিক প্রেসিডেন্টের ধারণা

সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি), স্বেচ্ছাসেবী মিলিশিয়া বাসিজ এবং সেনাবাহিনীসহ সব ধরনের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। আইআরজিসি এবং বাসিজ দেশটির সর্বোচ্চ নেতার বিশেষ অনুগত।

১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এ দুই বাহিনীর পেছনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছেন তিনি। সম্প্রতি এসব সংস্থার রাজনৈতিক নেতৃত্বে বেশ কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়েছে। যা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে একটি সম্ভাব্য মিশনের জন্য আইআরজিসিকে প্রস্তুত করছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।

ইরান : নিষেধাজ্ঞার রেস্তোঁরা

মার্চের শুরুর দিকে হোজ্জাত আল-ইসলাম আলী সাইদিকে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীতে খামেনির প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে; যিনি একই সঙ্গে খামেনির প্রতিনিধি হিসেবে আইআরজিসির দায়িত্বেও রয়েছেন। এই প্রতিনিধি শুধুমাত্র সর্বোচ্চ নেতার চোখ-কান হিসেবে কাজ করেন না; বরং আদেশ মানতে সেনা কর্মকর্তাদের বাধ্য করা এবং সর্বোচ্চ নেতার প্রতি অন্ধ অনুগত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি।

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সব ধরনের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক সংস্থা এবং শাখার নিয়ন্ত্রণও করবেন নব-নিযুক্ত সাইদি। আইআরজিসিতে তার উপ-সহকারী আব্দুল্লাহ হাজি সাদেগি একজন মৌলবাদী নেতা এবং সর্বোচ্চ নেতার একনিষ্ঠ অনুগত। তিনিও তার দায়িত্ব পালন করছেন।

মার্চেই আইআরজিসির রাজনৈতিক উপ-প্রধান হিসেবে জেনারেল ইয়াদোল্লাহ জাভানিকে নিয়োগ দেয়া হয়। খামেনির অন্যতম অনুগত এই কর্মকর্তা এর আগে সাইদির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালে দেশটিতে গ্রিন মুভমেন্ট নামে পরিচিত ব্যাপক গণবিক্ষোভে দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন সাইদি এবং জাভানি।

এসব নিয়োগের অর্থ হচ্ছে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরানি সামরিক বাহিনীর উপর তার রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করছেন। যাতে ব্যবস্থা নেয়ার দরকার হলে খামেনি দ্রুতই তার প্রতি সামরিক বাহিনী অনুগত থাকে।

দুটি দৃশ্যকল্পের জন্য তিনি আইআরজিসিকে প্রস্তুত করছেন বলে আপাত দৃশ্যে মনে হচ্ছে। প্রথমত, সঙ্কট যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে তাহলে আইআরজিসি রুহানিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবে। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি যদি স্থিতিশীল হয় তাহলে রুহানি তার মেয়াদ শেষ করার সুযোগ পাবেন এবং পরে আইআরজিসি দেশটিতে একজন সামরিক প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে।

গত কয়েক মাসে দেশটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কট্টরপন্থী ‘কীভাবে সেনাবাহিনী সমর্থিত একজন প্রেসিডেন্ট’ দেশের ভেতরের এবং আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান করতে পারেন সেব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছেন। অনেকেই কাশেম সুলেইমানিকে প্রেসিডেন্ট পদের পাশাপাশি আইআরজিসির প্রধানের জন্য সুপারিশ করেছেন। এর আগে ২০১৬ সালে তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াইয়ের গুঞ্জন বাতিল করে দেন। তবে চলতি বছরের বেশ কিছু জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, তিনি ইরানিদের কাছে রুহানির চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।

সামরিক প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনার এ আলোচনার উদ্দেশ্য জনগণের মতামত জরিপ নয়, বরং ইরানিদের মাঝে যে এক ধরনের কুসংস্কার আছে সেটিকে ভেঙে ফেলাও এর লক্ষ্য।

যদিও আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। তারপরও সামনের দিনগুলোতে ইরানের অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক সংকট যে আরো গভীর আকার ধারণ করবে তা অনেকটা অনুমেয়। যা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে বাধ্য করতে পারে।

লেখক: সৈয়দ গোলকার, প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব টেনেসি।

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...

যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সাথে কথা বলবে ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রুশ...

সিআইডি প্রধান হলেন গাজী জসীম

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন...

দেশের মাটিতে পা রাখলেন হামজা চৌধুরী

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশের মাটিতে পা রাখলেন...

পিরোজপুরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্র আটক

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে জোর করে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img