যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা ছিল আজ থেকে। তবে বাণিজ্য চুক্তি না সই হওয়া সত্ত্বেও এই শুল্ক আরোপের সময়সীমা পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। শুল্ক আরোপে বিলম্ব করায় বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য কিছুটা সময় বাড়লেও, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বাড়ছে অনিশ্চয়তা।
অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন
অধিকাংশ মূলধারার অর্থনীতিবিদ শুল্ক আরোপের বিরোধিতা করে থাকেন। কারণ, গবেষণায় দেখা গেছে—শুল্ক আরোপকারী দেশই শেষ পর্যন্ত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ে, কর্মসংস্থানে চাপ পড়ে এবং ভোক্তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যদিও এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের আগের শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বা কর্মসংস্থানে বড় প্রভাব পড়েনি, তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের প্রভাব সাময়িকভাবে ধীর গতিতে সামনে আসতে পারে।
অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এক উপমায় বলেন, “মূল্যস্ফীতি এখন এমন এক কুকুরের মতো, যে ঘেউ ঘেউ করছে না।” অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির প্রভাব ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে পারে।
শুল্কের প্রভাব
শুল্ক হলো আমদানি পণ্যের ওপর কর, যা উৎপাদন খরচ ও ভোক্তা দামে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানির অর্ধেকের বেশি অংশই হলো মধ্যবর্তী পণ্য, যা চূড়ান্ত পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে শুল্ক আরোপ মানে খরচ বাড়া, যা ভোক্তার কাঁধেই পড়ে।
২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের সময় নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে, এসব খরচ বাজারে সরাসরি প্রতিফলিত হয়। দাম বাড়ে। এছাড়া, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যৎ করনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে। ছোট ব্যবসাগুলোর বিনিয়োগ পরিকল্পনা কমে যায়।
চাকরি ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব
শুল্ক আরোপ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বদলে কখনো কখনো বেকারত্ব বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের ইস্পাত শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে স্টিল-নির্ভর খাতে কর্মসংস্থান কমে যায়। একইভাবে, ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের এক গবেষণায় দেখা যায়, শুল্ক খরচ বাড়ায়, চাকরি কমায়, এবং যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি পণ্যের ওপর অন্য দেশগুলো প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করে, যার ফলে ক্ষতির মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব
১৯৬৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৫১টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে এক গবেষণায় দেখা যায়, দীর্ঘ মেয়াদে শুল্ক অর্থনীতিকে সংকুচিত করে। শুল্ক কম থাকলে দেশগুলো প্রতিযোগিতামূলক খাতগুলোতে দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু শুল্ক বাড়ালে সেই দক্ষতা ব্যবহারে বাধা পড়ে।
বিকল্প নীতির পরামর্শ
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্প রক্ষা ও দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য শুল্ক নয়, বরং নির্দিষ্ট খাতে প্রণোদনা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি কার্যকর হতে পারে। শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ ও নতুন খাতে স্থানান্তরের মাধ্যমে ‘ন্যায়সংগত রূপান্তর’-এর মাধ্যমে এই প্রভাব মোকাবিলা করা যেতে পারে।
বাণিজ্য ঘনিষ্ঠতা ও নিরাপত্তা
জেপি মর্গানের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ডেভিড কেলি মনে করিয়ে দেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেবল লাভ-লোকসানের বিষয় নয়, এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংঘাত নিরসনের দিকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যখন দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর হয়, তখন যুদ্ধ বা দ্বন্দ্বের ঝুঁকি কমে।
উপসংহার
শুল্ক আরোপে বিলম্ব এবং অনিশ্চয়তা মার্কিন অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলছে। অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করছেন, ব্যবসার স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে শুল্কের পরিবর্তে কৌশলগত, নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক প্রণোদনা এবং স্বচ্ছ নীতি গ্রহণই হতে পারে কার্যকর সমাধান।