আনিসা বিনতে আমিন
শিল্প-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নগরী হিসেবে বিশ্বখ্যাত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস।।
হাজারো বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির শহর প্যারিস তাই দাগ কেটেছে হাজারো সংস্কৃতি প্রেমী ও দেশী-বিদেশী মানুষের মনে। বলা হয়ে থাকে, খুব ভাগ্যবান মানুষ হলেই নাকি প্যারস্য বা প্যারিস ভ্রমণ করতে পারেন।
জাদুর শহর ‘পারি’
মধ্যযুগ থেকে ফ্রান্সের প্যারিস পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক জীবনধারায় অভ্যস্ত।
ফ্রান্সের মানুষকে সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশনের মানুষ বলা হয়। আর তাই তো, প্যারিসে রয়েছে আধুনিকতম আধুনিকতার ছোঁয়া। প্যারিস শহরের নাম শুনলেই মনের গভীরে এক অন্যরকম অনুভূতি জেগে উঠে। চোখের সামনে ভেসে উঠে নানান ছবি ও নিদর্শন।

প্যারিস বা ‘পারি’ কে অনেকে আলোর শহর ও বলে থাকেন। আবার, জাদুর শহর নামটাও বেশ মুখরোচক। বিশ্বের ফ্যাশন জগতের রাজধানী, কেনাকাটা বিশেষ করে, পর্যটনের অন্যতম শহর এই পারি।
পারির অবস্থান
শহরটি উত্তর ফ্রান্সের ইল-দ্য-ফ্রঁস অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রে সেন নদীর তীরে অবস্থিত। প্রশাসনিক সীমানার ভেতরে প্যারিসের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ২,২১১,১৯৭ ।।

আবার, প্রশাসনিক সীমানা ছাড়িয়ে প্যারিসকে কেন্দ্র করে অবিচ্ছিন্নভাবে একটি সু-বৃহৎ নগর এলাকাও গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রায় এক কোটি লোকের বসবাস।
এই নগর এলাকা ও তার আশেপাশের প্যারিস-কেন্দ্রিক উপশহরগুলি মিলে প্যারিস এয়ার উর্বেন বা প্যারিস মেট্রোপলিটান এলাকা গঠন করেছে, যার জনসংখ্যাও প্রায় এক কোটির মতো। তাই, প্যারিস শহরটি ইউরোপের একটি বৃহৎ নগরী।
মজার শহর পারি
প্যারিসের বিখ্যাত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ বিশ্ববিখ্যাত আইফেল টাওয়ার। বিশ্বমেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে (১৮৮৯ সালে) গুস্তাফি আইফেল এটি নির্মাণ করেন।

আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য মানুষকে এতোটাই বিমোহিত করে যে, এ টাওয়ারকে কেন্দ্র করে ২০০৭ সালে এক নারীর সাথে তার স্বামীর তুমুল ঝগড়া হয় এবং শেষে সেই নারী তার স্বামীকে ডিভোর্স দেন এবং আইফেল টাওয়ারকে বিবাহ করেন! (অর্থাৎ তিনি ঘোষণা করেন আইফেল টাওয়ার তার স্বামী) তিনি আইফেল টাওয়ারের নামানুসারে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন Erik la Tour Eiffel
কী,মজার ব্যাপার না?
পারির আকর্ষণ “লুভ্য”

পারি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে এতোটাই সমৃদ্ধ যে, বিশ্বের যেকোনো কবি-সাহিত্যিকদের যদি প্রশ্ন করা হয় প্রথম কোন দেশ ভ্রমণ করতে চান, তাদের সোজা উত্তর হবে ফ্রান্সের প্যারিস। তাই প্যারিস নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের লেখালেখির শেষ নেই। আর প্যারিসের লুভ্যর মিউজিয়াম, বেশিরভাগেরই লেখালেখির মূল কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ এই মিউজিয়াম প্রায় সবারই পরিচিত। ফ্রান্সের এই মিউজিয়ামটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১২০০ সালে, কিন্তু এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় প্রায় ২০০ বছর আগে!

এই লুভ্যর স্বর্ণযুগ বলা হয় সম্রাট প্রথম নেপোলিয়ানের শাসনামলকে। তার নেতৃত্বেই সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ফ্রান্সের আধিপত্য বিস্তৃত হয় এবং মিউজিয়ামটির সংগ্রহশালা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।
তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে লুট করা মহামূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী ও শিল্পসম্ভার এখানে এনে সংরক্ষণ করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেগুলো আবার ঐসব দেশ কে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে জাদুঘরটি ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে এবং গ্রীক, মিশরীয় ও রোমান সাম্রাজ্যের নানা শিল্পনিদর্শন এখানে স্থান পেয়েছে।

বিস্ময়কর ও চমৎকার শিল্পবস্তু মোনালিসা ও ভেনাস দ্য মিলো এখানেই সংরক্ষিত রয়েছে।

ফুটবলার ফ্রান্স

ফ্রান্স নাম শুনলেই ফুটবল প্রেমীদের মনে আসে বিশ্বসেরা ফুটবলার জিনেদিন জিদান এর কথা। অবশ্য বর্তমানের তরুণ তারকা এমবাপ্পে ও কম নন। ফুটবল প্রেমীদের মনে গভীর আসন গড়েছেন তারা। আবার, বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব প্যারি সোঁ জেরমাঁ এদ ঘরের মাঠও এই ফ্রান্স। ইউরোপের ষষ্ঠ বৃহত্তম ক্রীড়া ময়দান স্তাদ দ্য ফ্রান্স এখানেই অবস্থিত।
উন্নত শহর প্যারিস

প্যারিস শহর যে উন্নয়ের শীর্ষে পৌছে গেছে তা অনায়াসেই বলা যায়। ২০০৬ সালে ফ্রান্সের মোট জাতীয় আয়ের এক-চতুর্থাংশেরও বেশী উৎপাদন করে প্যারিস, যার মূল্যমান ৫০০.৮ বিলিয়ন ইউরো (628.9 বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। তাই প্যারিসকে বলা হয় ইউরোপের বৃহত্তম পরিকল্পিত বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে ফ্রান্সের প্রধান প্রধান কোম্পানিগুলোর প্রায় অর্ধেকেরও বেশীর সদর দপ্তর অবস্থিত। বিশ্বের বৃহত্তম ১০০টি কোম্পানির ১৫ টির সদর দপ্তর এখানেই অবস্থিত। এছাড়াও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার যেমন-ইউনেস্কো, ওইসিডি, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স এর সদর দপ্তর ও এখানেই অবস্থিত।
অভিভূত ঐতিহ্যে ভরপুর পারি
ঐতিহ্যে প্যারিস বিশ্বের অনন্য বিস্ময়। প্রায় ৪০০ ধরণের বিভিন্ন খাবার ও পানীয় এখানে দেখা যায়। তাই তো ফ্রান্সের রান্না বিখ্যাত।
বিখ্যাত পানীয় শেমপেন তৈরী হয় ফ্রান্সে।
সিনেমা প্রেমীদের জন্য ও প্যারিস প্রেমময় স্থান। সিনেমা জগতের সবচেয়ে বড় উৎসব ক্যান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয় এখানেই।

অর্থাৎ আপনি যেই পেশার মানুষই হোন না কেন, প্যারিস আপনাকে তার সৌন্দর্যের মায়া জালে জড়াবেই! তবে এই জাদুর শহর যেই জাদুর দেশে অবস্থিত, সেই দেশের পুরোনো ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া যাক?
ফ্রান্সের ইতিহাস
জাদুর দেশ ফ্রান্সের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তবে ফ্রান্সের সর্বপ্রথম অধীবাসীদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের গুহায় পাওয়া ছবিগুলি প্রায় ১৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বলে ধারণা করা হয়। খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে কেল্টীয় ও অন্যান্য গোত্রের লোকেরা এখানে প্রবেশ করে ও বসবাস শুরু করে। তারা ফ্রান্স কে কেল্টীয় গল নামে ডাকতো। তবে ফ্রান্সে প্রথম শাসনপর্ব শুরু হয় রোমানদের হাতে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে। তাদের পতনের পর ধারাবাহিকভাবে নানা সামন্তবাদী রাজবংশ ফ্রান্স শাসন করে।

সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর শাসনামলে ফ্রান্স একটি সংহত প্রশাসনিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
আধুনিকতার শীর্ষে, ছন্দে-রূপে-গুণে-মাধুর্যে বিশ্বের সব মানুষের পছন্দনীয় ও প্রয়াসী দেশ ফ্রান্স ও শহর প্যারিস।
প্যারিস যেমন ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প সংস্কৃতিতে ভরপুর, তেমনি আইন কানুন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশ্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ফ্রান্স।। ফ্রান্সের এই অপরুপ সৌন্দর্য যেন চিরযৌবনা!