লিখেছেন নাহিদ আহসান ||
ফ্রান্সের ধর্মীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ও লেখক বার্নার্ড লিকোমতির মতে আইফেল টাওয়ার যদি প্যারিস হয় তাহলে নটর ডেম হচ্ছে ফ্রান্স। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত বিখ্যাত নটর ডেম ক্যাথেড্রাল ছিলো প্রায় ৮৫০ বছর পুরানো গির্জা, যা হয়ে উঠেছিলো ফ্রান্সের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য নিদর্শন।
বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী ১৫ই এপ্রিল, ২০১৯ তারিখের রাত ১০ টা ৫০ মিনিটে আগুন লাগে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রসিদ্ধ এ তীর্থভূমিতে। প্রায় আট ঘন্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও ততোক্ষণে ফ্রান্সের এই অনন্য নিদর্শন প্রায় ভস্মীভূত। এই গির্জার ভারী পাথরের অবকাঠামোগুলো রক্ষা করা গেলেও, প্রায় সব মূল্যবান জিনিশপত্র ই পুড়ে গেছে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল মাঁখো এই গির্জা পুননির্মানের ঘোষণা দিয়ে তহবিল সংগ্রহের কথা ও জানিয়েছেন।
১৯৫১ সালে সুইজারল্যান্ড এর গ্র্যান্ড থিয়েটার অফ জেনেভা, ১৯৯৪ সালে স্পেনের গ্র্যান্ড থিয়েটার ডেল লিকেউ, ১৯৯৬ সালে ইতালির ভেনিস অপেরা হাউজ, ২০১৮ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও তে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর এর পরে অগ্নিকান্ঠে ধ্বংসস্তূপ এ পরিণত হওয়া তালিকায় নাম লেখালো ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের হৃদয়খ্যাত, প্রসিদ্ধ এই তীর্থস্থান, ‘ নটর ডেম গির্জা ‘। প্রায় ৮৫০ বছর পুরানো এই ক্যাথেড্রালের নানান বিষয় সম্পর্কে চলুন জেনে নেয়া যাক।
সাল ১১৬৩, উপস্থিত প্রধান অতিথি পোপ তৃতীয় আলেকজান্ডার, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো এই নটর ডেম ক্যাথেড্রালের। ধীরে ধীরে বেশ সময় নিয়ে এর নির্মাণকাজ চলতে থাকে, ১২৫০ সালের দিকে শেষ হয় প্রথম ধাপের নির্মাণ কাজ। তারপর শুরু হলো দ্বিতীয় ধাপের নির্মাণ কাজ। মূল অবকাঠামোর মধ্যে এবার সংযুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন রকমের জিনিশপত্র। শিল্পকর্মে জুড়ে দেয়া হয় পুরো ফ্রান্সের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনচিত্র।
ইউরোপের ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যখান থেকে গোথিক শিল্পের যেই আবির্ভাব ঘটে, সেই গোথিক শিল্পের প্রাচুর্য, গোথিক স্থাপত্যের প্রাচুর্য ভাবা হয় এই নটর ডেম ক্যাথেড্রালকে। শতো শতো বছরের হস্তনির্মিত শিল্পকর্মাদি স্থাপিত হতে থাকে এই গির্জায়। গির্জাটি তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় ১৮২ বছর। দ্বাদশ শতকে নটরডেম ক্যাথেড্রালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে কাজ সম্পন্ন হয়েছে ত্রয়োদশ শতকে। ভ্রমণ বিষয়ক মার্কিন গাইডবুক ফোডোর’স ট্রাভেল থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
মজার ব্যাপার হলো, ১৫৭২ সালে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি ও মাহগোহিত দে ভেলোয়ার বিয়ে করেন এবং বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় এই গির্জায়।
সম্পূর্ণ ক্যাথেড্রালটির আয়তন ৫,৫০০ বর্গমিটার এবং এর কলাম-পিলারের সংখ্যা ৭৫ যেসব নির্মাণ করা হয় ১৩০০ ওকে গাছ দিয়ে। টাওয়ারগুলোর উচ্চতা হয় ৬৯ মিটার। প্রধান চূড়ার উচ্চতা ৯৬ মিটার। পুরো ক্যাথেড্রালটির মোট দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে পাওয়া যায় ১২৮ মিটার। ১২৮ মিটার দীর্ঘ এ গির্জার অন্যতম আকর্ষণ বিখ্যাত অর্গান বাদ্যযন্ত্র। বিখ্যাত এই অর্গান বাদ্যযন্ত্র প্রায় ৫৬ নোটওয়ালা পাঁচটি কী-বোর্ড, ৮০০০ এর মতো পাইপ, ৩২ টি নোটওয়ালা প্যাডেল বোর্ড এবং ১০৯ টি স্টপ নিয়ে বানানো। বিখ্যাত এই অর্গান বাদ্যযন্ত্র বসানো হয় ১৭৩০ সালে। তার কয়েক দশক পরেই যখন ফরাসি বিপ্লব ঘটে তখন এই ক্যাথেড্রালের নামকরণ করা হয় ‘টেম্পল অব রিজন’।
ভ্রমণ বিষয়ক অস্ট্রেলীয় গাইডবুক ” লোনলি প্ল্যানেট ” থেকে জানা যায় পোপ পাইয়াস সপ্তমের হাত ধরে ফ্রান্সের রাজা হিসেবে নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট এর অভিষেক হয় এই বিখ্যাত নটর ডেম ক্যাথেড্রালে। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ভরপুর এই ক্যাথেড্রালেই ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরির মাথায় ওঠে ফ্রান্সের রাজার মুকুট। ঊনিশ শতকের শেষে যখন আইফেল টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শেষ হয় তার আগ পর্যন্ত নটরডেম গির্জার টুইন বেল টাওয়ারকেই বলা হতো প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু ভবন।
রয়েল একাডেমি অব পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচারের সহযোগিতায় ক্যাথিড্রালের অভ্যন্তরে অসংখ্য ভাস্কর্য, মূর্তি ও চিত্রকর্ম বসানো হয়েছে, যেখানে রয়েছে বাইবেলের দৃশ্য আর ঋষিরা। এর মধ্যে ৭৬টি চিত্রকর্মের একটি সিরিজের দৈর্ঘ্য প্রায় চার মিটার লম্বা। নটরডেম গির্জার অভ্যন্তরে হস্তনির্মিত খ্রিষ্টানদের পবিত্র কিছু নিদর্শন আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় যীশুর মাথায় থাকা ‘ক্রাউন অব থর্নস’। তাকে যেখানে বেঁধে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় সেই ট্রু ক্রসের খণ্ড আর পেরেকও আছে। এক বার্তা সংস্থায় প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো নিশ্চিত করেছেন, আগুন ধরার পর ক্রাউন অব থর্নস ও সেন্ট লুইয়ের পোশাকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিস উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক ট্রাভেল এজেন্ট ইয়ারন ইয়ারিমি ইমেইলে সিএনএনকে জানিয়েছিলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ মধ্যযুগীয় গির্জাগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে এটি অন্যতম। আমরা প্যারিসে যদি ভ্রমণ আয়োজন করি তাহলে যেই স্থানগুলোতে ভ্রমণের আবেদন সবচেয়ে বেশি আসে তার মধ্যে এই নটর ডেম ক্যাথেড্রাল অন্যতম।’ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০,০০০ এর মতো দর্শনার্থী আসতো এই গির্জায়। প্রতি বছর প্রায় ১৪ মিলিয়নের অধিক।
১৫ ই এপ্রিল আগুনে ভস্মীভূত হবার আগ পর্যন্ত নিঃসন্দেহে এই ক্যাথেড্রাল ছিলো এক অনন্য নিদর্শন যা বিশ্বের দরবারে ফ্রান্সের ঐতিহ্য, ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে রাখতো বিশেষ ভূমিকা। আটঘন্টার এক দুর্ঘটনায় সব ইতিহাস সম্বলিত তথ্যচিত্র এবং হস্তশিল্প ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলেও ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল মাঁখোর আবেদনে সারা দিয়ে যদি এই ক্যাথেড্রালটি আবার সম্পূর্ণ রূপে বানানো সম্ভব হয় আরও সংস্কার করে, তাহলে ফ্রান্স ফিরে পাবে তাদের এক প্রতিনিধি যা বিশ্বদরবারে তাদের সংস্কৃতিকে নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়। যদিওবা এই নটর ডেম গির্জা বানাতে সময় লেগেছিলো প্রায় ১৮২ বছর, এখন আবার সম্পূর্ণ রূপে মেরামত করে বানাতে আরও এক শতাব্দী তো লাগতেই পারে।