বিশ্ব রাজনীতিতে পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্যতম কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘মধ্যম পাল্লার পরমাণু অস্ত্র চুক্তি’ (INF Treaty) ছিল একটি যুগান্তকারী মাইলফলক, যা পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার লাগাম টেনে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে হঠাৎ করেই রাশিয়া এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়ে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এক অপ্রত্যাশিত অনিশ্চয়তার সূচনা করেছে।
সোমবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, রাশিয়া আর মধ্যম ও স্বল্পপাল্লার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন সংক্রান্ত কোনো সীমাবদ্ধতা মানবে না। বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত শুধু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দুর্বলই করেনি, বরং পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কেও নতুন করে উত্তেজনা এবং স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও পশ্চিমাদের হুমকি-ভাবনা
আলজাজিরা ও দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া INF চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত সাবমেরিন রাশিয়ার আশেপাশের অঞ্চলে মোতায়েনের নির্দেশনার পরপরই রাশিয়া এই ঘোষণা দেয়।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউরোপ এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের একতরফা নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার আর কোনো অর্থ নেই।” এছাড়া, রুশ রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আরটি জানিয়েছে, পশ্চিমাদের ‘বেপরোয়া ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বৃদ্ধি’ রাশিয়ার জন্য সরাসরি হুমকি বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
ন্যাটোকে দায়ী করে সাবেক প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে চুক্তি ভঙ্গের জন্য ন্যাটো দেশগুলোকেই দায়ী করেন। তিনি আরও জানান, মস্কো এর প্রতিক্রিয়ায় ভবিষ্যতে আরও পদক্ষেপ নিতে পারে, যদিও সেসব বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি।
বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল
বিশ্ব নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ভিত্তিকে আরও দুর্বল করে তুলবে। ইতোমধ্যে ‘নিরস্ত্রীকরণ’ নয় বরং অস্ত্র পুনঃমজুত ও নতুন মোতায়েনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। অনেক বিশেষজ্ঞই এই পরিস্থিতিকে ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধের’ সূচনা হিসেবে দেখছেন, যেখানে সামরিক প্রযুক্তি, প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ও রাজনৈতিক উত্তেজনার নতুন মাত্রা দেখা যাচ্ছে।
চুক্তির পটভূমি ও পূর্ববর্তী সংকট
উল্লেখযোগ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে রাশিয়ার চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে INF চুক্তি থেকে নিজে থেকেই সরে দাঁড়ায়। তখন রাশিয়া বলেছিল, যদি যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের অস্ত্র মোতায়েন না করে, তবে তারাও করবে না। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে পশ্চিমা সামরিক জোটগুলোর নানামুখী তৎপরতা মস্কোকে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ গত ডিসেম্বরে এক বক্তব্যে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর খামখেয়ালি কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়াকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।”
১৯৮৭ সালের ঐতিহাসিক INF চুক্তিটি সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তির আওতায় ৫০০ থেকে ৫,৫০০ কিলোমিটার পাল্লার ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
রাশিয়ার সদ্যঘোষিত সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে কূটনৈতিক চাপ ও সামরিক উত্তেজনা বাড়াবে, তা স্পষ্ট। এখন দেখার বিষয়—বিশ্বনেতৃবৃন্দ এই সঙ্কট নিরসনে কোন পথে এগিয়ে যান।