“উমর দরাজ মাঙ্গঁকে লায়েথে চার দিন
দো আরজুমে কাট গয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ।”
বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ আসে “চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম। দু’টি কাটল প্রত্যাশায় আর দু’টি অপেক্ষায়।”
এই চরণ দুটি বাহাদুর শাহ জাফরের। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কথাই বলছি। দিল্লির লাল কেল্লায় ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সাম্রাজ্য হারিয়ে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় কবিতা লিখেই সময় কাটাতেন তিনি।
পিতার মৃত্যুর পর বাহাদুর শাহ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন বাহাদুর শাহ। সিংহাসন তখন নামমাত্র চলছিলো। বাহাদুর শাহ এর পিতামহ এবং পিতা উভয়ই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী।
তিনি নিজেও বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ভাতা পেতেন। পিতার মতো বাহাদুর শাহ নিজের ও মুঘল খান্দানের ভরণপোষণে ভাতা বৃদ্ধির জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন।
বৃটিশ সরকার রাজি হয়েছিলো শর্ত দিয়ে। শর্ত ছিলো “বাদশাহ” উপাধি ত্যাগ করতে হবে আর লালকেল্লার বাইরে সাধারণ নাগরিকের মতো জীবনযাপন করতে হবে। এই শর্তে রাজি হননি বাহাদুর শাহ।
সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সম্রাটের মনোমালিন্য হয়। সম্রাটের ক্ষমতা ও মর্যাদা নষ্ট করতে তৎপর হয় কোম্পানি। এ সময় বেদনা ভুলে থাকার জন্য সম্রাট গজল ও মুশায়েরায় নিমগ্ন থাকতেন ; লালকেল্লায় সাহিত্যের আসর বসিয়ে সময় কাটাতেন।
কেল্লায় অভ্যন্তরে ভালোই কাটছিলো দিন। সিংহাসনে বসার বিশ বছর পর্যন্ত সব চলছিলো একই রকম। হঠাৎই চিত্র পাল্টে গেলো ভারত বর্ষের। বিদ্রোহীর দানা বাঁধলো ব্যারাকে। সিপাহি বিদ্রোহের কথা বলছি। যারা ইতিহাস নিয়ে কখনই খোঁজ খবর রাখেন না তাদের কানেও নিশ্চয় এসেছে এই বিদ্রোহের কথা। সিপাহি বিদ্রোহ যখন শুরু হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দমদম সেনাছাউনিতে।
আর ১১ই মে সিপাহিরা দিল্লি অধিকার করে এবং সেদিন তাঁরা লাল কেল্লায় প্রবেশ করে।
নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করে সিপাহিরা। সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেয় তারা। এ দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্রাটকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মান জানানো হয়। সম্রাটের বয়স তখন ৮২ বছর।
সম্রাট নিজে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতবর্ষে। বিদ্রোহ লাভ করে নতুন রূপ।
একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে।
‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহি’ স্লোগানে চলতে থাকে বিদ্রোহ। তবে ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীর রক্তে রঞ্জিত হয় ভারতবর্ষের মাটি। ইংরেজরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সম্রাট ২১ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করেন। ইংরেজ সৈন্যরা মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান, মীর্জা আবু বকরসহ ২৯ জন মুঘল শাহজাদাসহ বহু আমির ওমরাহ, সেনাপতি ও সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তার শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ না নিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।
রেঙ্গুনে পাঠানো হয় সম্রাটকে। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের ছোট গ্যারেজে সম্রাট ও তার পরিবার-পরিজনের বন্দিজীবন শুরু হয়। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয় একটা পাটের দড়ির খাটিয়ায়। রেঙ্গুনেই ইতি ঘটে মোঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাটের। স্বদেশের ভূমিতে জায়গা হলো সম্রাটের। এই দুঃখে তিনি লিখেছিলেন, মরনেকে বাদ ইশক্ব মেরা বা আসর হুয়া উড়নে লাগি হ্যায় খাক মেরি ক্যোয়ি ইয়ার মে; কিৎনা বদনসিব জাফর দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে’
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন।সে সময় তিনি পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেন –
“দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে , পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে”।
১৭৭৫ সালের ২৪ শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন এই সম্রাট। চ্যানেল আগামীর পক্ষ থেকে সম্রাটকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধার সাথে।