Thursday, July 10, 2025
30.2 C
Dhaka

বাহাদুর শাহ জাফরঃ মোঘল চলচিত্রের শেষ নায়ক

“উমর দরাজ মাঙ্গঁকে লায়েথে চার দিন
দো আরজুমে কাট গয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ।”

বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ আসে “চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম। দু’টি কাটল প্রত্যাশায় আর দু’টি অপেক্ষায়।”
এই চরণ দুটি বাহাদুর শাহ জাফরের। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কথাই বলছি। দিল্লির লাল কেল্লায় ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সাম্রাজ্য হারিয়ে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় কবিতা লিখেই সময় কাটাতেন তিনি।

পিতার মৃত্যুর পর বাহাদুর শাহ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন বাহাদুর শাহ। সিংহাসন তখন নামমাত্র চলছিলো। বাহাদুর শাহ এর পিতামহ এবং পিতা উভয়ই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী।

তিনি নিজেও বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ভাতা পেতেন। পিতার মতো বাহাদুর শাহ নিজের ও মুঘল খান্দানের ভরণপোষণে ভাতা বৃদ্ধির জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন।
বৃটিশ সরকার রাজি হয়েছিলো শর্ত দিয়ে। শর্ত ছিলো “বাদশাহ” উপাধি ত্যাগ করতে হবে আর লালকেল্লার বাইরে সাধারণ নাগরিকের মতো জীবনযাপন করতে হবে। এই শর্তে রাজি হননি বাহাদুর শাহ।

সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সম্রাটের মনোমালিন্য হয়। সম্রাটের ক্ষমতা ও মর্যাদা নষ্ট করতে তৎপর হয় কোম্পানি। এ সময় বেদনা ভুলে থাকার জন্য সম্রাট গজল ও মুশায়েরায় নিমগ্ন থাকতেন ; লালকেল্লায় সাহিত্যের আসর বসিয়ে সময় কাটাতেন।
কেল্লায় অভ্যন্তরে ভালোই কাটছিলো দিন। সিংহাসনে বসার বিশ বছর পর্যন্ত সব চলছিলো একই রকম। হঠাৎই চিত্র পাল্টে গেলো ভারত বর্ষের। বিদ্রোহীর দানা বাঁধলো ব্যারাকে। সিপাহি বিদ্রোহের কথা বলছি। যারা ইতিহাস নিয়ে কখনই খোঁজ খবর রাখেন না তাদের কানেও নিশ্চয় এসেছে এই বিদ্রোহের কথা। সিপাহি বিদ্রোহ যখন শুরু হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দমদম সেনাছাউনিতে।

আর ১১ই মে সিপাহিরা দিল্লি অধিকার করে এবং সেদিন তাঁরা লাল কেল্লায় প্রবেশ করে।
নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করে সিপাহিরা। সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেয় তারা। এ দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্রাটকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মান জানানো হয়। সম্রাটের বয়স তখন ৮২ বছর।
সম্রাট নিজে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতবর্ষে। বিদ্রোহ লাভ করে নতুন রূপ।
একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে।

‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহি’ স্লোগানে চলতে থাকে বিদ্রোহ। তবে ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীর রক্তে রঞ্জিত হয় ভারতবর্ষের মাটি। ইংরেজরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সম্রাট ২১ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করেন। ইংরেজ সৈন্যরা মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান, মীর্জা আবু বকরসহ ২৯ জন মুঘল শাহজাদাসহ বহু আমির ওমরাহ, সেনাপতি ও সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তার শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ না নিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।

রেঙ্গুনে পাঠানো হয় সম্রাটকে। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের ছোট গ্যারেজে সম্রাট ও তার পরিবার-পরিজনের বন্দিজীবন শুরু হয়। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয় একটা পাটের দড়ির খাটিয়ায়। রেঙ্গুনেই ইতি ঘটে মোঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাটের। স্বদেশের ভূমিতে জায়গা হলো সম্রাটের। এই দুঃখে তিনি লিখেছিলেন, মরনেকে বাদ ইশক্ব মেরা বা আসর হুয়া উড়নে লাগি হ্যায় খাক মেরি ক্যোয়ি ইয়ার মে; কিৎনা বদনসিব জাফর দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে’

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন।সে সময় তিনি পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেন –
“দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে , পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে”।

১৭৭৫ সালের ২৪ শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন এই সম্রাট। চ্যানেল আগামীর পক্ষ থেকে সম্রাটকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধার সাথে।

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান দিবসে সবার জন্য ১ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট দেবে সরকার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে দেশের সব নাগরিককে এক জিবি...

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি পরিচালনায় ন্যায্য দরপত্র চেয়ে রিটের আদেশ ২৩ জুলাই

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব ন্যায্য...

এমবাপ্পে নাকি ভিনিসিয়ুস: পিএসজির বিপক্ষে রিয়ালের একাদশে কার জায়গা পাকা

চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের আগমুহূর্তে কঠিন এক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি রিয়াল...

এসএসসি ফল প্রকাশে থাকছে না কোনো আনুষ্ঠানিকতা: শিক্ষা উপদেষ্টা

চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে...

গুজরাটে সেতু ধসে ভয়াবহ দুর্ঘটনা, নিহত অন্তত ১০

ভারতের গুজরাট রাজ্যের ভদোদরায় মহিসাগর নদীর ওপর নির্মিত ৪৩...

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে ১২৩৫ ফুট গভীরে দুর্ঘটনায় চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ১ হাজার ২৩৫ ফুট গভীরে...

ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে এক দিনে ডিএমপির ১১৬৭টি মামলা

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে...

শুল্ক আরোপে বিলম্ব করলেন ট্রাম্প, তবু ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা কাটছে না

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img