ইভান পাল
গতকাল ভোর থেকেই দেখছি, চারদিকে হৈ হৈ উৎসব। গান, নাচ,আড্ডা আবার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর হাজারো কর্মসূচী। ব্যানার, ফেস্টুন আর মাইক, সাউন্ড বক্স নিয়ে তো বিরাট ব্যাপার-স্যাপার!
আর চারুকলায় দেখছি আকাঁ-আকিঁ’র ধুম পড়েছে। ওখানকার ভাইয়া,আপুরা দেখছি সকাল থেকে শুধু রং তুলি দিয়ে তাদের ক্যানভাসে ঘষছে আর ঘষছে।
কি হয়েছে আদ্যপান্ত তো কিবসন্তের ডাক শুনে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!
পরে কোন এক ব্যানারে চোখে পড়ল — “বসন্ত উৎসব”। বসন্ত উৎসব!
আরে, তার মানে আজ ফাগুন এর ১তারিখ।
বোঝো!
তাই তো বলি, কেন মঞ্চে সব্বাই গাইছে, “ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে”।
তাই তো, সত্যি ফাগুন ইই লেগেছে বনে বনে। চারদিকে।তাই এত্ত আনন্দ, এত্ত ভালবাসার হাওয়া বইছে চারদিকে।
আর তার জন্য ই বোধ হয় গতকাল মানে ১লা ফাগুনে মেয়েদের খুব কমন পোশাক ছিল হলুদ কিংবা বাসন্তী রং এর শাড়ী। সাথে ছিল বাসন্তীফুলে জড়ানো খোপা। কারো কারো কপালে ছিল আবার লাল টিপ। বাহ,কি অপূর্ব, অপরুপ দৃশ্য!
আর ছেলেদের পরনে ছিল হলুদ রং এর পাঞ্জাবী। সাথে জিন্স ই বেশী চোখে পড়ে। তবে কেউ কেউ আবার ফতুয়াও পড়ে। কিন্তু রংটা কমন। সেই হলুদ।
তবে মুষ্টিমেয়’র ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়।
কারণ, হলুদ যে বসন্তের রং। আবার মেয়েরা লাল ও পড়ে। এক কথায় বলি, রঙ্গিন রং এ রাঙ্গানো পোশাক ই সবাই পছন্দ করে। বসন্ত ই যে রাঙ্গিয়ে দেওয়ার ঋতু। নানা রঙ্গে এই প্রকৃতিকে রাঙ্গিয়ে দিতেই যে তার আগমন ঘটে। আর প্রকৃতি নির্ভর এই মানবজীবনও তখন বসন্তের রঙ্গে রাঙ্গা হয়ে ওঠে।
যাক,বসন্ত নিয়ে এত্ত কথার মাঝে একটা কথা তো আমি ভুলতেই বসেছি। আর তা হল- আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি।। প্রতি বছর ই ১লা ফাল্গুন অর্থাৎ এই বসন্তের পরদিন ই থাকে ভালবাসা দিবস যা সকলের কাছে ভ্যালেনটাইনস ডে নামেই বেশী পরিচিত।।আমি তো একটা কথা আগেই বলেছি, বসন্ত মানেই হল ভালবাসার ঋতু। প্রেমের ঋতু। সে এই ভুবনভোলানো প্রকৃতিতে আসে অজস্র অজস্র ভালবাসা নিয়ে।
তাই যতদূর মনে হয় বসন্তের ডাক শুনেই বুঝি, এই ভালবাসা দিবসের আগমন ঘটে!
আপনাদের অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ভালবাসা দিবস!
ভালবাসতে কি নির্দিষ্ট দিন লাগে নাকি!
তবে আমি এযুগের এক ক্ষুদ্র মানব হয়ে নি:সন্দেহে একথা বলতে পারি, ভালবাসা দিবস আছে নাকি একথা আপনারা কেউই বলবেন না।
কারণ, এই একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে তথ্য-প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোয়ায়ঁ বাচ্চা থেকে বুড়ো সব্বার মুখে মুখে একটা শব্দ ই কেবল ঘুরতে থাকে আর তা হল, ১৪ ই ফেব্রুয়ারি মানেই — ভ্যালেনটাইন্স ডে।।
যদিওবা এই ভ্যালেনটাইন্স ডে আমাদের বাঙ্গালি সংস্কৃতি’র কোন অংশই নয়। বরং, বলা চলে পশ্চিমা সংস্কৃতির ই একটা অন্যতম উৎসব। কিন্তু, এখন আর তা শুধু পশ্চিমা সংস্কৃতির মধ্যেই সীমাবব্ধ নয়, বর্তমানে এটি পুরো বিশ্বের একটি অন্যতম বিশেষ উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ ই তাদের নিজস্ব ঢং,নিজস্ব রীতিতে এই উৎসবটি উদযাপন করে থাকেন।
এইদিনে মূলত:ভালবাসার মানুষটিকে ফুল কিংবা ভালবাসার মানুষটির পছন্দের সামগ্রী দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
সে ভালবাসার মানুষটি যে কেউ ই হতে পারে মা-বাবা, ভাই বোন কিংবা বন্ধু, বান্ধবীও হতে পারে।। আবার এও সত্যি কথা যে,ভালবাসতে কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষনের প্রয়োজন হয় না।
ভালবাসা চিরন্তন, ভালবাসা সার্বজনীন। তবে এটা ঠিক যে, কোন এক বিশেষ মানুষের জন্য হয়তো বা তা একটু বেশী ই থাকে, আলাদা থাকে।।
যাক, আমি শিরোনামে একটা কথা বলেছি কিন্তু। আর তা হল– ভালবাসা দিবসের আখ্যান ।।
আখ্যান শব্দের অর্থ হল ইতিহাস। হুম ঠিক ধরেছেন। আজ একটু ভালবাসা দিবসের ইতিহাস নিয়েই বলব। এই ভ্যালেন্টাইনস ডে কি, কোত্থে এলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে ইতিহাসে ঢোকার আগে এই নিয়ে রবি ঠাকুর দুটো গানের লাইন ভীষণ মনে পড়ে যাচ্ছে।
“প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে–বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও।
ভুলিব ভাবনা, পিছনে চাব না,– পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও”।।
কিংবা
“তোমার খোলা হাওয়া… লাগিয়ে পালে
টুকরো করে কাছি , আমি ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি ।
তোমার খোলা হাওয়… লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া”।।
ভালবাসা দিবসে বিরহ নয় বরং প্রেমের জোয়ারে ভাসুক এই পুরো পৃথিবীর মানবকুল। আর ফাগুনের খোলা হাওয়ায় মানব মন ভেসে যাক ভালবাসার মহিমায়।।
কবিগুরু যে তারঁ এদুটো গানে ভালবাসার ইই বন্দনা করেছেন তা নি:সন্দেহে স্বীকার্য।
ভালবাসা দিবস নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে। এর মধ্যে একটি মত হল–
২৬৯ সালে ইতালির রাজধানী রোমে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ছিলেন। যিনি আবার পেশায় চিকিৎসকও ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট
দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি ওই কারাগারের কারারক্ষীর দৃষ্টহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।যার ফলে ভ্যালেন্টাইনের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। আর তারপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।(ভ্যালেন্টাইন্স ডে: উইকিপিডিয়া)

Sacred Heart Mission, Jesselton (1922)
আবার কেউ কেউ মনে করেন যে — রোমান সম্রাট ক্রাডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স কে তারঁ জনপ্রিয়তার জন্য নয় বরং সে কারারক্ষীর মেয়ে যাকে তিনি সুস্থ করে তুলেছিলে, তারঁ সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু সম্রাট এ গোপন প্রেমের বিষয়টি জানতে পেরে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের প্রতি রাগান্বিত হন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইন তার সেই প্রেমিকা যাকে তিনি চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। আর সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর পর কারা প্রধান চিরকুটটি দিয়েছিলেন সেই মেয়েটিকে। বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং এ দেখতে এ চিরকুটে লেখা ছিল , ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ (‘From your Valentine’)। আর দিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন।ভালবাসার এসব কীর্তির জন্য এই দিনটিকে মানুষেরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করে আসছে ।

আবার কারো কারো মতে–
রোম সম্রাট ক্রাডিয়াস ২০০ খ্রিস্টাব্দে দেশে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা দেন, আজ থেকে কোনও যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ। তার মতে, যুবকরা যদি বিয়ে করে তবে তারা তাদের প্রিয়তমা কিংবা পরিবার ছেড়ে যুদ্ধে যেতে চাইবে না। আর ভ্যালেন্টাইন নামের এক যুবক সম্রাট ক্লডিয়াসের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন ।অসীম সাহসী এ যুবকের প্রতিবাদে খেপে উঠেছিলেন রোমান সম্রাট ক্রাডিয়াস আর সে যুবকের বিরুদ্ধে আনা হয় রাজদ্রোহের অভিযোগ। আর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মাথা কেটে ফেলা হয় তার।ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এ দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।।
তবে কোন কোন মনীষী মনে করেন,
প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেব-দেবীর রানী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। আর তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মানুষেরা এই দিনটি উপলক্ষে প্রায় কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করে। ভালবাসা দিবসে পাশ্চাত্যের প্রতিটি মানুষ তার ভালবাসার মানুষটির জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী ক্রয় করে। যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনে প্রায় ২.৫ থেকে ৩ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
যাক, ভালবাসা দিবসের পোশাক এর কথায় যদি বলি তাহলে বলতে হয়–
বসন্তের পরদিন ইই যখন ভালবাসা দিবস, তাই নারীদের সেই বসন্তের সাজটিই থাকে।
তবে এদিন হলুদ বা বাসন্তী রঙ্গের শাড়ীর পরিবর্তে লাল বা যেকোন উজ্জ্বল বর্ণের পোশাক ই তারা বেশী পড়েন। আর ছেলেদের ক্ষেত্রেও সেই উজ্জ্বল রঙ্গের পোশাক ই বেশ চোখে পড়ে। কারণ, বসন্ত আর ভালবাসা দিবস দুটোই যে রঙ্গিন রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দেওয়ার ঋতু।
তবে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র একটা খুব কমন ব্যাপার থাকে আর তা হল তরুণ তরুণীদের হাতে গোলাপ ফুল। গোলাপ ছাড়া যেন এ উৎসব উদযাপিত ইই হয় না।আর কারো হাতে আবার থাকে চকোলেট কিংবা হরেক রকম গিফট।।
আর ভালবাসা দিবসে আলাদা করে খুব একটা উৎসব বা অনুষ্ঠান চোখে পড়ে না। কারণ– আমরা যে বাঙালি। আর আমাদের প্রাণের উৎসব যে বসন্ত উৎসব। আর প্রকৃতির সব ভালবাসা যে বসন্ত ই ডেকে আনে।
এই ভালবাসা দিবস যদিওবা প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য। কিন্তু তারপরও একজন মানুষের ভালবাসার ব্যাপ্তি যেহেতু তার আশেপাশের অনেক প্রিয়জন কে ঘিরে বিস্তৃত। তাই ভালবাসা দিবস সকলের জন্য।
আর ভালবাসতে নির্দিষ্ট কোন দিন ক্ষনের প্রয়োজন পড়ে না। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবস। তাই শুধু যে ১৪ই ফেব্রুয়ারি’র দিন ই ভালবাসবে একে অন্য কে তা কিন্তু একে বারেই নয়। বরং বলি ভালবাসতে কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষনের প্রয়োজন হয় না।
ভালবাসা চিরন্তন, ভালবাসা সার্বজনীন।।
ভাল থাক এই পৃথিবীর সব ভালবাসার মানুষগুলো।।