হাসান ইনাম
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম ‘পলাশী’। পলাশী নামটি এসেছে লাল রঙের ফুল পলাশ থেকে। ‘পলাশী’ শব্দটা শুনলেই অবচেতন মনে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একই সাথে বেশ কয়েকটা নাম – নবাব সিরাজোদ্দৌলা, রবার্ট ক্লাইভ, মীর জাফর। ১৭৫৭ সালের আজকের এইদিনে পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের মুখোমুখি হন বাংলার শেষ নবাব সিরাজোদ্দৌলা। ইংরেজ বাহিনীর ছিলো – ইউরোপীয় সৈন্য ২,১০০ জন ভারতীয় সিপাহি ১০০ বন্দুকবাজ, ৯টি কামান (আটটি ৬ পাউন্ডার ও একটি হাওইটজার) অপরদিকে নবাবের পক্ষে ছিলো প্রাথমিকভাবে ৫০,০০০ সৈন্য আর ৫৩টি কামান।
যুদ্ধের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীর জাফর, ইয়ার লুৎফ খান ও রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মীর মদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীর মদন এবং অপর সেনাপতি মোহন লাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হন ও মারা যান। নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান প্রমুখ গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানও একইসাথে মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের এই পরিস্থিতে নবাব তার দুই সেনাপতি মীর জাফর ও রায় দূর্লভকে তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা উভয়ই অযুহাত দেখিয়ে নবাবের নির্দেশ অমান্য করেন। তাদের অযুহাত ছিলো গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।
যুদ্ধের এমন পরিস্থিতে সেনাপতি মীর জাফর এবং তার সহযোগীরা নবাবকে যুদ্ধ বিরতি করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহন লাল নবাবকে পরামর্শ দেন যুদ্ধবিরতি ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সিরাজ মীর জাফর এবং তার সহযোগীদের পরামর্শে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। বিকেল পাঁচটায় সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করে। নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজদের পক্ষে ৭ জন ইউরোপীয় এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়। তখন কোনো উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য ২,০০০ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি। সিরাজউদ্দৌলা তাঁর সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাপতি মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রাজা রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তাঁর সে আশা পূর্ণ হয়নি। সিরাজ পথিমধ্যে বন্দি হন ও মিরনের হাতে বন্দি অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে।